হুমায়ূন আহমেদ আর হুমায়ুন আজাদের দেখা
৯ এপ্রিল ২০২০তা অনেক কথাই তো হতে পারে৷ তবে কথা শুরু হলে কোনো-না-কোনো সময় নিজেদের লেখালেখির প্রসঙ্গ আসবেই৷ এই প্রসঙ্গ নাকি দুজনের বন্ধুত্বে ইতি টেনেছিল৷ মুখ দেখাদেখিও নাকি বন্ধ হয়েছিল দুজনের৷
হুমায়ূন আহমেদ তখন ‘দুই হাতে লিখছেন’, তরতর করে বাড়ছে তার জনপ্রিয়তা৷ অথচ লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ তখনো একেবারে বিপরীত মেরুর৷ প্রকাশকদের চাহিদার তুলনায় অনেক কম লেখেন, লেখা আদায় করতে নাকি একরকম জোরজবরদস্তি করতে হয় কোনো কোনো প্রকাশকের৷ একবার নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘হুমায়ূন আহমেদ এত লিখছেন, আপনি এত কম লেখেন কেন?'' হুমায়ুন আজাদ তার জবাবে শৈশবে মুখস্থ করা ‘‘অ্যাকসেস অফ নাথিং ইজ গুড’’ কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন প্রশ্নকর্তাকে৷ তবে স্মরণ করালেন নিজের ভঙ্গিতে৷ বললেন, ‘‘ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি৷’’
কুকুর-বিড়াল বা মানুষ ছাড়া অন্য যে কোনো প্রাণী স্বেচ্ছায় জন্মনিয়ন্ত্রণ করে বলে সত্যিই আমাদের জানা নেই৷ তাই বলে লেখালেখির সঙ্গে ‘ইতর প্রাণী'র বেশুমার সন্তান জন্মদানের তুলনা! ব্যাস, দুজনের বন্ধুত্ব শেষ! হুমায়ুন আজাদের কথিত এই আপত্তিকর মন্তব্যে হুমায়ূন আহমেদ কষ্ট পেলেও লেখক হিসেবে তার কোনো ক্ষতি হয়নি৷ অনেক লেখার মধ্যে কিছুতো অবশ্যই কালজয়ী হয়েছে৷ সুতরাং লেখক হিসেবে তার জীবন সার্থক বলা যেতেই পারে৷
জীবনের ওপারে দুজনের দেখা হলে, কথা হলে হুমায়ুন আজাদও নিশ্চয়ই তা মানবেন আর মানলে আবার বন্ধু হতে সমস্যা কোথায়?
করোনা ভাইরাসের কারণে চলমান সংকট নিয়েও নিশ্চয়ই কথা হবে তাদের৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, কোটি কোটি দরিদ্রের জীবনে নেমে আসছে অনিশ্চয়তার আরো ঘন অন্ধকার- এসবও নিশ্চয়ই উঠে আসবে আলোচনায়৷ মন খারাপ হবে খুব৷
কিছু বিষয়ে হয়তো জম্পেশ তর্কও হবে৷ ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় ইহকালেও তো ভিন্নমত ছিল দুজনের৷ সুতরাং সামান্য বিতর্ক হতেই পারে৷
তবে এ যুগে সব স্তরে ভাষার চর্চা আর লেখালেখির প্রসঙ্গে তারা যে ‘দ্বৈত সংগীত' গাইবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷
মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে চিঠি লেখালেখি প্রায় বন্ধ৷ আগে যারা মোটামুটি ভালো চিঠি লিখতেন বা লিখতেন না, তাদের অনেকেই এখন ব্যস্ত লেখক৷ বইমেলায় একসঙ্গে গোটা চারেক বই প্রকাশ করাও তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না৷ যদিও হুমায়ূন আহমেদ নেই, হুমায়ুন আজাদও নেই এখন৷
এসবের শুরু অবশ্য দেখে গেছেন তারা৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় মুরাদ টাকলাদের দাপট না দেখলেও এসএমএসে ‘আই লাভ ইউ’কে ইলু, ‘আই মিস ইউ’- কে ইমু লেখা প্রজন্মের সাক্ষাৎ হিমুর স্রষ্টা হুমায়ূন তো পেয়েছেনই৷
ইলু, ইমু লেখিয়েদের নিয়ে প্রয়াত দুই ‘হুমায়ুনের’ অবশ্য বেশি মাথা ঘামানোর কথা নয়৷ লেখক, পরিচালক, শিল্পী এমনকি সাংবাদিকদেরও বড় একটা অংশও যখন খুব তাড়াতাড়ি কোনো ‘কাজ নামানো’কে বিশাল সার্থকতা মনে করে, কোনো কাজ পাঠক বা দর্শক ‘খাবে কিনা’ সেটাই যখন অনেকের মূল বিবেচ্য, তখন ইমু, ইলুতে ঘিলুক্ষয় তারা করবেন কেন!
কিন্তু করোনা কালেও অনেকের সৃষ্টি-সুখের উত্তাল প্রকাশ নিশ্চয়ই ভাবাবে তাদের৷ হুমায়ূন আহমেদও বলতে বাধ্য হবেন, ‘‘ওরা এত বেশি লেখে কেমন করে?’’
লজ্জায় নুয়ে আসবে হুমায়ুন আজাদের মাথা, কাচুমাচু ভঙ্গিতে শুধু বলবেন, ‘‘বন্ধু, খুব ভুল বলেছিলাম আমি৷ এত বেশি তুমিও লিখতে পারোনি!’’