‘ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য সব দলই ব্যবহার করে’
২ এপ্রিল ২০২১
ইউটিউবে ডয়চে ভেলে বাংলার ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে এমনটাই বললেন পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অজন্তা দেব রায়৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে বাংলার সাপ্তাহিক ইউটিউব টকশো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়'-এ আজকের পর্বে আলোচক হিসেবে ঢাকা থেকে উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর এবং লন্ডন থেকে ছিলেন পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অজন্তা দেব রায়৷ এবারের পর্বে আলোচ্য বিষয় ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতার বীজ'৷ প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে কেন হয় ভাঙচুর, এর দায় কার?
আলোচনায় সঞ্চালক প্রশ্ন করেন কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দেশের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব বাড়িয়েছে৷ কথা হয় পুলিশ-প্রশাসনকে আগ্রাসী হতে উস্কানি দেওয়ার বিষযে৷ এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অজন্তা দেব রায় তোলেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বদলের প্রসঙ্গ৷ তিনি বলেন, ‘‘কিছু কিছু বিষয় আমাদের মনস্তত্ত্বে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছে যে, আমরা খুব সহজেই উস্কে যাই৷ ঠিক যেমন ধর্ম৷ ধর্মসম্পর্কিত কোনো কথা ব্যবহার করলে আমাদের লাইক-ফলোয়ার বেড়ে যায়৷ আওয়ামী লীগ বলেন, হেফাজতে ইসলাম বলেন, বিএনপি, জামাত, যুব লীগ বা ছাত্র লীগ বলেন, এমনকি যুব অধিকার পরিষদের নূর, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার, সহিংসতার রাজনীতির একটা বীজ ঢুকে গেছে৷ প্রত্যেকেই জানা-অজানায় সেটার চর্চা করেন৷ ধর্মকে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য৷ একজন মানুষ ধর্মকে অনুসরণ করতে পারেন, কিন্তু ধর্ম রাজনীতিতে চলে এলে সেটা সমস্যা সৃষ্টি করে৷’’
একই বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর উত্থাপন করেন সাম্প্রদায়িকতা শব্দের সাথে ধর্মকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার বিষয়টি৷ তিনি বলেন, ‘‘ইসলাম ধর্মের একজন মানুষ হিসাবে বলি, ধর্ম কখনো অন্য কারো অধিকার খর্ব করার কথা বলে না৷ ইসলাম ধর্ম সম্প্রীতির কথা বলে৷ আর যারা ধর্মকে বিকৃত করে অপপ্রচার করে, তাদের প্রতি আমি চিরকালই আমার ঘৃণা প্রকাশ করি৷ কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমরা এমন একটা জাতি, যারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করেছি৷ সেই ইসলামী অতি-আবেগের দিকে দেশের মানুষ কর্ণপাত করেননি৷’’
অনুষ্ঠানে আরো আলোচিত হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সংগঠনগুলির বেড়ে ওঠা, প্রতিবাদের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিশেষ বিচার-বিবেচনা ও এতে সরকারপক্ষের ভূমিকার মতো নানা প্রসঙ্গ৷
এসএস/এসিবি
সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে দূর করা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আট নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কথা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সাদেকা হালিম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে৷ এছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করলে অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব৷ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে৷ আরেকটি বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধর্মের সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
গোলাম কুদ্দুস, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
কোনো ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না৷ পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে৷ তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেউ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে৷ দেশের প্রতিটি মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
আইনুন নাহার সিদ্দিকা, আইনজীবী
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সব রকমের রাজনৈতিক উস্কানি বন্ধ করতে হবে৷ আমরা যেন এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের পেছনে কখনো না লাগি৷ সবাই সবার ধর্মকে সম্মান করি৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
শেখ শাফায়াতুর রহমান, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কখনো শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা যাবে না৷ আমাদেরকে আমাদের বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
রেখা শাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে দেশের সর্বত্র সকল ধর্মের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ সবাই যেন সবার ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ এছাড়া সবাই মিলে একটি দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারলে সাম্প্রদায়িকতাও দেশ থেকে দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
খরাজ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা, পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ৮৫ শতাংশ মেকআপ আর্টিস্টই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের৷ কই, আমাদের তো সমস্যা হয় না! আমরা মন থেকে কোনও বিভেদে বিশ্বাস রাখি না৷ তাই নিজেদের মধ্যেও বিভেদ জন্মায় না৷ মনের অন্ধকার দূর করাটাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার৷
সত্যিকারের জ্ঞান মনের সংকীর্ণতা দূর করে৷ তাই শুধু ডিগ্রি দিয়ে লাভ নেই৷ জ্ঞানের আলো জ্বালাতে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে৷ সেটাই হবে আদর্শ জ্ঞাননির্ভর সমাজ৷ সেই সমাজ এমন মানুষ তৈরি করবে, যার মধ্যে উগ্রতা থাকবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
পতিতপাবন রায়, পিয়ারলেস, পশ্চিমবঙ্গ
ব্যক্তিগতস্তরে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু সমষ্টিগতস্তরে মানতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন৷ দেওয়ানি বিধির অধীনে সবাইকে রাখতে হবে৷ রাজনীতির অনুপ্রবেশ রুখে সবার জন্য সমান আইন প্রণয়ন দরকার৷ তবেই রাস্তা আটকে নামাজ পড়া বা মণ্ডপ তৈরি নিয়ে দাঙ্গা হবে না বা রক্তও ঝরবে না৷