1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আক্রান্ত

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা২৬ এপ্রিল ২০১৬

৬০ ঘণ্টার ব্যবধানে আরো পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাঁদের অন্তত চারজন যে উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত৷ কলাবাগানে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পদক জুলহাস মান্নানসহ দু'জনকে৷

ব্লগার হত্যার প্রতিবাদ
ছবি: DW

জুলহাসসহ দু'জনকে সোমবার বিকেলে হত্যা করা হয়৷ এর আগে সকালেই গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগারের সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান কারারক্ষী রুস্তম আলীকে ফটকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের এ সব হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘‘নিরাপত্তাহীনতা' বোধ করার কোনো কারণ নেই৷''

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথার কয়েক ঘণ্টার মাথায় কলাবাগনে নিজ বাসায় খুন হন জুলহাস মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব তনয়৷ জুলহাস এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পদক ছাড়াও বাংলাদেশে ইউএসএইড-এর কর্মকর্তা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন৷ তাঁদের হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা ‘আল্লাহু আকবর' ধ্বনি দেয়৷

জুলহাস বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতা নিয়ে কাজ করতেন৷ তার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পাদনা করতেন তিনি৷ ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে লিঙ্গ সমতার প্রতীক হিসেবে ‘রেইনবো ব়্যালি'-র আয়োজন করে আসছিলেন৷ পরপর দু'বছর এই ব়্যালি করতে পারলেও এ বছর পহেলা বৈশাখে ব়্যালি করতে দেয়নি পুলিশ৷ ব়্যালি বের করার চেষ্টা করলে চারজনকে আটক করা হয়৷ এই ঘটনার পর থেকেই জুলহাস অনেকটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন বলে জানা যায়৷

গত শনিবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যা করা হয় রাজশাহীর শালবন এলকায় তাঁর বাসার সামনে৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস তাঁকে হত্যার দায় স্বীকার করে৷ অধ্যাপক রেজাউল সংস্কৃতি এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন৷ ছোট কাগজ বের করতেন৷

সোমবারের তিন-তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ রবিবার, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় একইভাবে পরমানন্দ রায় নামে এক হিন্দু সাধুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷

কাশিমপুর কারাগারের সাবেক কারারক্ষীকেও সাম্প্রতিক বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের মতো মোটরসাইকেল আরোহীরাই হত্যা করে৷ পুলিশ বলছে, এখনো হত্যাকাণ্ডের পিছনে কোনো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি৷

এর আগে এ মাসের শুরুতেই ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিম উদ্দীন সামাদেকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়৷ সেই হত্যারও দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিরা৷

বাংলাদেশে এখন সেক্যুলারিস্ট বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ তাঁদের কখনো ‘নাস্তিক', কখনো ‘ইসলাম বিরোধী' আবার কখনো ‘ধর্মের অবমাননাকারী' আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে৷ পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট যে, যাঁরা উগ্রপন্থিদের হামলার শিকার হচ্ছেন তাঁরা মুক্তচিন্তা, ভিন্নধর্মের, ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তা, বিদেশি বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী৷ হামলা ও হত্যার সংখ্যা ও পরিধি বাড়ছে৷ কিন্তু একটি মাত্র ব্যতিক্রম ব্লগার রজীব হায়দার হত্যা ছাড়া আর কোনো ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার বা বিচারের আওতায় আনার নজির নেই৷

একের পর এক হত্যা

বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করার মধ্য দিয়ে প্রথম জঙ্গিদের মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু হয়৷

এরপর ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী এবং ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঢাকার পল্লবিতে৷

২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আশরাফুল আলমকে৷

১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অভিজিত্‍ রায়কে৷ হামলায় গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ৷

৩০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় খুন হন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু৷

১২ মে সিলেটে খুন হন আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ৷ তিনিও গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷

৭ আগস্ট ঢাকার বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের আরেক কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে৷

২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে তাভেল্লা সিজার নামের এক ইটালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়৷

৩ অক্টোবর রংপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে৷

৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড'-এর ফাদার লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷

৩১ অক্টোবর ঢাকায় অভিজিত্‍ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে লালমাটিয়ায় কুপিয়ে জখম করে জঙ্গিরা৷ একই দিনে অভিজিতের আরেক প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়৷

১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামে এক ইটালীয় পাদ্রিকে হত্যার চেষ্টা হয়৷

২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন, আহত হন আরও চারজন৷

২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন৷

এরপর ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল রাতে ঢাকার সূত্রাপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে৷

২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷

একইভাবে আক্রমণ, তারপর হত্যা

প্রায় প্রতিটি ঘটনায় জঙ্গিরা দায় স্বীকার করেছে৷ এছাড়া ব্যক্তি আক্রমণের ক্ষেত্রে একই স্টাইলে মোটর সাইকেল আরোহীরা কুপিয়েছে বা গুলি করেছে৷ অন্যান্য আক্রমণের ক্ষেত্রে বোমা বা গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়৷ হত্যার স্টাইল খুবই নৃশংস৷ পুলিশ প্রধানত জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের দু'টি জঙ্গি সংগঠনকে এ সব হামলা এবং হত্যার জন্য দায়ী করছে৷ তবে তাদের গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় আনার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই৷

সুলতানা কামাল

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশের মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সেক্যুলার, ভিন্নমতের মানুষ বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আজ আক্রান্ত৷ যারা আক্রমণ এবং হত্যা করছে, তারা মনে করছে তাদের চিন্তার সঙ্গে যাদের মিল নেই তাদেরই হত্যা করতে হবে৷ এবং তারা তা অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছে৷ এটা সম্ভব হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে৷ এই অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, তাদের বিচারও হচ্ছে না৷''

তিনি বলেন, ‘‘উগ্রপন্থিরা যে কোনো অজুহাত তৈরি করছে হত্যার জন্য, কারণ, তাদের চিন্তার সঙ্গে যারা একমত নয় তাদেরকে তারা ধ্বংস করে দিতে চায়৷ একটি উগ্রগোষ্ঠী তাদের উগ্রপন্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়৷ সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়, তাহলে এই দেশে ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তা ধর্মনিরপেক্ষতা – যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, তা বজায় রাখা কঠিন হবে৷''

বাংলাদেশে কেন বিচারহীনতার সংস্কৃতিবিরাজ করছে? জানান আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ