চরমপন্থা ও অসহিষ্ণুতা মোকাবিলা করতে ধর্মীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ বুধবার সকালে ইন্দোনেশিয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোর সাথে দেখা করার পর এই কথা বলেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
পোপ বলেন, ‘‘একটি শান্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসূ সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আন্তঃধর্মীয় সংলাপ জোরদার করতে চায় চার্চ৷'' চরমপন্থিরা ধর্মের বিকৃতির মাধ্যমে প্রতারণা ও সহিংসতা ব্যবহার করে তাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উইডোডোও পোপের মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভ্যাটিকানের সঙ্গে মিলে ইন্দোনেশিয়া একটি ক্রমবর্ধমান অশান্ত বিশ্বের মধ্যে স্বাধীনতা ও সহনশীলতা ছড়িয়ে দিতে চায়৷''
জার্মান পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের জীবনের নানা কথা
অবসরপ্রাপ্ত পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট নিজের দেশ জার্মানিতে সম্মানীয় এক ব্যক্তি৷ গির্জায় যৌন নিপীড়নের একটি ঘটনার তদন্ত চলাকালীন তিনি ভুয়ো তথ্য দিয়েছিলেন এমন কথা শোনা গিয়েছিল৷ ওই ঘটনার সমালোচনাও হয়েছিল৷
ছবি: dapd
‘আমরা পোপ’
২০০৫ সালের ১৯ এপ্রিল শীর্ষস্থানীয় জার্মান ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’-এ শিরোনাম ছিল ‘আমরা পোপ’৷ আটাত্তর বছর বয়সি ইয়োসেফ রাৎসিঙার-কে ২৬৫তম পোপ নির্বাচিত করে কলেজ অফ কার্ডিনাল৷ প্রায় ৫০০ বছর পর কোনও জার্মান পোপ হিসেবে দায়িত্ব পান৷ দ্বিতীয় জন পলের মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে পোপের দায়িত্ব নেন ষোড়শ বেনেডিক্ট৷ নম্রস্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রভু যিশুর আঙুরক্ষেতের এক সাধারণ নগণ্য কর্মীকে নির্বাচন করেছেন কার্ডিনালরা৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Kleinschmidt
ঈশ্বরের প্রতি সারা জীবন সমর্পণ
১৯২৭ সালের ১৬ এপ্রিল রাৎসিঙারের জন্ম হয়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি৷ পরে গির্জার রীতি মেনে কার্ডিনাল হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/German Catholic News Agency KNA
যুদ্ধের সন্তান
যুদ্ধের সময় রাৎসিঙারের বয়স ১৬৷ ওই বয়সে হিটলারের যুববাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল তাকে৷ তিনি জানান, সংগঠকরা তাকে বাহিনীর কাজে আসতে বন্ধ করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে আর যাননি৷ এটি ১৯৪৩ সালে রাৎসিঙারের ছবি৷ ১৯৪৪ সালে ভেয়ারমাখটে কাজ করেছিলেন তিনি৷ যুদ্ধ শেষে মার্কিন বাহিনী তাকে বন্দি করে৷ ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/STF
যাজক, অধ্যাপক, পোপ
ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন রাৎসিঙার৷ ১৯৫২ সালে তিনি পড়ানো শুরু করেন৷ রেগেনসবুর্গে মাত্র ৩০ বছর বয়সে অধ্যাপক নির্বাচিত হন৷ প্রাথমিকভাবে গির্জার একজন প্রগতিশীল সদস্য হিসাবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে৷ শোনা যায়, ১৯৬০ সাল নাগাদ ছাত্র বিক্ষোভের সময় তিনি আরও রক্ষণশীল হয়ে উঠেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/KNA
প্রভাবশালী ধর্মতাত্ত্বিককে রোমে ডেকে পাঠানো হলো
মিউনিখ এবং ফ্রাইসিং-এর আর্চবিশপ হওয়ার চার বছরের মাথায় তত্কালীন পোপ দ্বিতীয় জন পোল রোমে নিয়ে যান রাৎসিঙারকে৷ সেখানে এই ধীমান ধর্মতাত্ত্বিক দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন৷ ধর্মীয় মতবাদমণ্ডলীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয় তাকে৷ এদিকে যাজক হিসেবে অভিজ্ঞতা ছিল সীমিত৷ একজন শিক্ষাবিদ তিনি৷ কীভাবে গির্জার এমন উচ্চপদে তিনি আসীন হলেন, এই নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রক্ষণশীলতার পথে
ক্রমশই রক্ষণশীল হয়ে উঠছিলেন কার্ডিনাল রাৎসিঙার৷ তত্কালীন পোপ দ্বিতীয় জন পলও ছিলেন রক্ষণশীল৷ গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার পরামর্শ, গর্ভনিরোধের বিরোধিতা এবং লাতিন আমেরিকান লিবারেশন থিওলজি – এসব ছিল তার বৈশিষ্ট্য৷ পোপ থাকাকালীন তিনি রক্ষণশীলতার পথে অবিচল ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গির্জার সংকটে
২০০৯ সালে সোসাইটি অফ সেইন্ট পিওসের চার বিশপের বহিষ্কার প্রত্যাহার করেন তিনি৷ এই বিশপদের একজন হলোকাস্টকে অস্বীকার করেছিলেন, যা নিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন শুরু হয়৷ ষোড়শ বেনেডিক্টের কার্যকালকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দুর্বল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, বিশ্বব্যপী অগ্রগতির অভাব এবং সর্বোপরি ধর্মযাজকদের দ্বারা নাবালকদের যৌন নির্যাতন৷ কয়েক দশক ধরে এই সব গোপন ছিল৷
ছবি: Getty Images
যৌন নির্যাতনের ‘চাবুক’
যৌন নির্যাতনের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন ষোড়শ বেনেডিক্ট৷ নিগৃহীতদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাও করেন৷ যাজক দ্বারা নির্যাতনকে ‘আঘাত’ বলে উল্লেখ করে মারাত্মক কষ্টের কথাও বলেছিলেন তিনি৷ যাজকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিধিনিষেধ আরও কঠোর করেছিলেন৷ সমালোচকদের দাবি, সেগুলি যথেষ্ট কড়া ছিল না৷ ভ্যাটিকানে এই বিষয়ে প্রথমবার বড়মাপের সংকট বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন তাঁর উত্তরসূরি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মানি থেকে সমালোচনা
জার্মানির এয়ারফুর্ট শহরে তাঁকে দেখতে জনসমাগম হয়৷ সেখানে তিনি সমাদৃত হলেও কঠোর সমালোচনাও হয়েছিল তাঁকে নিয়ে৷ পৃথক সম্প্রদায়ের দম্পতির মধ্যে সম্পর্ককে পবিত্র সম্পর্ক হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন তিনি৷ বিশ্বব্যাপী এটিকে মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যান হিসাবে দেখা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইসলামের সঙ্গে সংঘাত
২০০৭ সালে মাইনৎস শহরের কার্নিভাল প্যারেডে ষোড়শ বেনেডিক্টের প্রতিমূর্তি ছিল৷ তাতে দেখা গিয়েছিল তিনি মসজিদে পোপমোবিল চালাচ্ছেন৷ পোপের একটি বিতর্কিত বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত ছিল সেখানে৷ বাইজেন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় ম্যানুয়েল প্যালিওলোগোসের উদ্ধৃতি দিয়ে ষোড়শ বেনেডিক্ট বলেছিলেন, নবী মোহম্মদ পৃথিবীতে শুধু অশুভশক্তি এবং অমানবিকতা নিয়ে এসেছেন৷ তার এ জাতীয় শব্দ চয়ন মুসলিম সমাজের মধ্যে বিতর্ক তৈরি করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert
ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ষোড়শ বেনেডিক্ট রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন৷ বয়সের কারণে শারীরিক ক্ষমতা কমেছে, এমন কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷ মহান সার্বভৌমত্ব হিসেবে দেখা হয়েছিল তার পদক্ষেপকে৷ এর আগে স্বেচ্ছায় পোপের পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৭০০ বছর আগে৷ ভ্যাটিকানের একটি ধর্মস্থানে বাকি জীবন কাটাচ্ছেন ষোড়শ বেনেডিক্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler
দু’জন পোপ?
২০১৩ সালে পদত্যাগের পর বেনেডিক্ট তার উত্তরসূরি ফ্রান্সিসকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেন৷ কিন্তু বাস্তবে তিনি সরব হন কয়েক বছর পর৷ ২০২০ সালে একটি বইয়ে ‘ইমেরিটাস পোপ’ যাজকদের ব্রহ্মচর্য ত্যাগের বিরুদ্ধে তীব্র যুক্তি দিয়েছিলেন৷ যদিও পোপ ফ্রান্সিস বিবাহিত পুরুষদের যাজক হিসাবে স্বীকৃতির সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি৷
ছবি: Reuters/Vatican Media
মিথ্যা সাক্ষ্য
ষোড়শ বেনেডিক্ট তাঁর সাবেক মিউনিখ আর্চডায়েসেসে যৌন নির্যাতনের তদন্তে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য ২০২২-এর ২৪ জানুয়ারি ক্ষমা চেয়েছেন৷ তিনি জানান, কোনও খারাপ উদ্দেশ্য থেকে নয়, অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ছিল সেটি৷ অবসরপ্রাপ্ত পোপ একটি তদন্তে জানিয়েছিলেন, ১৯৮০ সালের একটি বৈঠকে তিনি উপস্থিতি ছিলেন না, যেখানে একজন শিশুনিগ্রহকারী যাজককে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
13 ছবি1 | 13
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের চার দেশ সফরের অংশ হিসেবে পোপ ফ্রান্সিস এখন বিশ্বের সবচেয়ে মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় আছেন৷ এরপর পাপুয়া নিউগিনি, পূর্ব তিমুর ও সিঙ্গাপুর যাবেন তিনি৷
তৃতীয় পোপ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া সফরে গেছেন ৮৭ বছর বয়সি পোপ ফ্রান্সিস৷ শেষবার ১৯৮৯ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল ইন্দোনেশিয়া সফর করেছিলেন৷
ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ৮০ লাখ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশের কম৷ আর মুসলমানের সংখ্যা ২৪ কোটি ২০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৭ শতাংশ৷
ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্ম ছাড়াও আরও চারটি ধর্মকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ইন্দোনেশিয়া৷ এগুলো হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, প্রোটেস্ট্যান্ট ও কনফুসিয়ানিজম৷
বৃহস্পতিবার জাকার্তায় অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইস্তিকলাল মসজিদে স্বীকৃত ছয় ধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন পোপ ফ্রান্সিস৷
এরপর ইস্তিকলাল মসজিদের ঠিক বিপরীতে রাস্তার অপর পাশে অবস্থিত ক্যাথিড্রালে বক্তব্য রাখবেন পোপ ফ্রান্সিস৷
মসজিদ ও ক্যাথিড্রালের মধ্যে একটি ‘বন্ধুত্বের টানেল' রয়েছে, যেটি এই দুই ধর্মের প্রার্থনাস্থলকে সংযোগ করেছে৷