ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, তারা অভিন্ন বিধির পক্ষে৷ এই অবস্থান ক্ষিপ্ত করেছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের৷ কেন কেবল মুসলিম সম্প্রদায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে আপত্তি জানাচ্ছে?
বিজ্ঞাপন
অভিন্ন বিধি সবচেয়ে বেশি ধাক্কা মারবে ‘তিন তালাক' এবং সম্পর্কচ্ছেদ করা স্ত্রীকে খোরপোষ না দেওয়ার প্রচলিত প্রথায়৷ এ কারণেই ‘মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড' বলেছে, ‘‘ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনতে তৎপর হয়েছে৷'' মুসলিম সমাজ চলে শরিয়ত আইন মেনে, সেই আইনের কোনোরকম রদবদল করা যায় না বলেই দাবি করছেন তাঁরা৷
সত্যিই কি তাই? আজকের মুসলিম নেতারা বলছেন, ভারত বহু ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতির দেশ৷ সেই ‘বহুত্ব' রক্ষা করার দায় সরকারের, বিচারবিভাগের৷ মুসলিম সমাজে যদি তিন তালাকে বিয়ে ভাঙা বা বিবাহবিচ্ছিন্ন মহিলাদের প্রাক্তন স্বামীর থেকে খোরপোষ না পাওয়ার অধিকারই স্বীকৃত থাকে, তা হলে সেটাই চলতে দিতে হবে৷ যদি বাকি দেশের আইন-কানুনের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য না থাকে, তা হলেও!
কিন্তু ঘটনা হলো, স্বাধীনতার পর ভারতের যে নেতারা দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, সেই জওহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, ভি আর আম্বেদকর এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদ, এঁরা সবাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধিরই পক্ষে ছিলেন৷ অর্থাৎ এক দেশ, একটিই আইন৷ সব সম্প্রদায়, সব ধর্ম, নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যে এক আইন৷ আজকে নয়, সেই ১৯৪৯ সালে এটা নিয়ে প্রথম বিতর্ক হয়েছিল সংসদে৷ অমীমাংসিত সেই প্রশ্ন তার পর ফের উত্থাপিত হয় ১৯৫১ এবং '৫৪ সালে৷ কিন্তু সংসদ সদস্যরা কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণের ভার রাজ্যগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ তার জেরেই তৈরি হয় বিভিন্ন পার্সোনাল ল বোর্ড, ধর্ম এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক, পরস্পরের থেকে আলাদা৷ কিন্তু ভারত যে বহুত্বের ধারণা থেকে একদিন এক ঐক্যবদ্ধ দেশের চেহারা নেবে, সংবিধান–প্রণেতাদের এই মৌলিক ভাবনায় কোনো দ্বিমত ছিল না৷
ভারতের কিছু বিতর্কিত আইন
ভারতে এমন কিছু কিছু আইন আছে, যা খুবই স্পর্শকাতর৷ তাই এ সব আইন নিয়ে প্রশ্ন তুললেই শুরু হয়ে যায় তুমুল বিতর্ক৷ তখন শেষ পর্যন্ত আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, দিতে হয় সমাধান৷ এই রকমই কয়েকটি আইন তুলে ধরা হলো ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters
৩৭০ ধারা
ভারতীয় সংবিধানের এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় কতগুলি ক্ষেত্রে স্বশাসনের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্য গণপরিষদ এর সংশোধনের সুপারিশ না করায়, এটা এ মুহূর্তে স্থায়ী বিধান হয়ে আছে৷ তবে জাতীয় নিরাপত্তা, অত্যাবশ্যক পণ্য, সর্বভারতীয় নিয়োগ বিধি, কর ও শুল্ক, আদালত, মানবাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর অন্যান্য রাজ্য থেকে অভিন্ন৷
ছবি: Mohammadreza Davari
সোচ্চার সংঘ পরিবার
৩৭০ নম্বর ধারা রদ করার জন্য ভারতে সংঘ পরিবারের মতো কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলি জোর আন্দোলন শুরু করেছে৷ সরকারকে তারা ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে এ জন্য৷ তাদের মতে, এই ধারা ভারতের সংহতি ও অখণ্ডতার পরিপন্থি৷ শুধু তাই নয়, এই ধারা নাকি জম্মু-কাশ্মীরের অশান্ত পরিস্থিতির জন্য অনেকখানি দায়ী৷ সরকার অবশ্য এই বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চাইছে না৷
ছবি: AP
এএফএসপিএ বা আফস্পা
সেনাবাহিনীর বিশেষ অধিকার আইন বা এএফএসপিএ কার্যকর হয় ১৯৫৮ সালে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য এবং জম্মু-কাশ্মীরে৷ জঙ্গি তৎপরতা রুখতে এই আইনে সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে অবাধ ক্ষমতা৷ এতে করে ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার, যখন খুশি তল্লাসি, কোনো কারণ না দেখিয়ে আটক এবং নির্যাতন করতে পারে মিলিটারি৷ তবে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, এ আইন অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবত থাকতে পারে না৷ বরং ক্ষেত্রবিশেষে তদন্ত করতে হবে৷
ছবি: AP
প্রতিবাদী নারী শর্মিলা চানু
মানবাধিকার সংগঠনগুলি আফস্পার বিরুদ্ধে সোচ্চার৷ অভিযোগ, গত দু’দশকে মনিপুরে এ আইনকে কাজে লাগিয়ে সাজানো সংঘর্ষে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার ও মনিপুর থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৬ বছর ধরে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন লৌহমানবী ইরম শর্মিলা চানু৷ নাকে ১৬ ইঞ্চির টিউব লাগানো তাঁর এই প্রতিবাদী ছবি গোটা দুনিয়া চেনে৷ আত্মহত্যার মামলা দায়ের করেও তাঁকে থামানো যায়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images
৩৭৭ ধারা
ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতা এখনও অপরাধ৷ সমলিঙ্গের দুই প্রাপ্তবয়স্ক যদি পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনকাজে লিপ্ত হয় এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলেও ৩৭৭ নং ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ১০ বছরের জেল, এমনকি যাবজ্জীবন কারাবাসও হতে পারে৷ ভারতের সমকামী গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তিস্বাধীনতার খেলাপ মনে করে এই আইন বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিীন ধরে৷ তবে বিষয়টি নিয়ে ভারতের জনমত বিভাজিত৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/R. Kakade
এলজিবিটি সম্প্রদায়ের নতুন পিটিশন
সম্প্রতি ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ৩৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদটির বিরুদ্ধে আবারো পিটিশন দায়ের করেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কয়েকজন সেলিব্রেটি৷ বের হয় মিছিলও৷ হাতের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনে লেখা থাকে ছিল, ‘সমকামীদের ব্যক্তিগত জীবন বেছে নেবার অধিকার দিতে হবে৷’ ঋতু ডালমিয়া, আমন নাথ এবং নৃত্যশিল্পী এনএস জোহর-এর মতো তারকারা ছিলেন সেই মিছিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পণপ্রথা বিরোধী আইন
ভারতে আজও পণপ্রথা বিরোধী আইনের ৪৯৮-এ ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কখনও কখনও ঘটে যায় বধু হত্যার মতো ঘটনা৷ এই ধারা অনুযায়ী, বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে স্ত্রী আত্মহত্যা করলে বা তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে, স্বামী বা অন্য সদস্যদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা নির্দোষ৷ তা নাহলে বধু নির্যাতনের অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে৷ তবে স্ত্রী যাতে এই আইনের অপব্যহার না করেন, সেদিকটাও এবার খতিয়ে দেখতে চায় আদালত৷
ছবি: Narinder Nanu/AFP/Getty Images
আত্মহত্যা না খুন?
এ বছরের জানুয়ারি মাসে দিল্লির ফতেপুর বেরিতে ২২ বছরের নববিবাহিতা বধু ববিতাকে শ্বশুরবাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ বৌটির বাপেরবাড়ির লোকেদের অভিযোগ, পণের জন্য ববিতার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতো তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা৷ আর সে কারণেই ববিতা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় অথবা আত্মহত্যার মোড়কে তাঁকে খুন করে শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই৷
ছবি: Getty Images/AFP
জাতিভেদ প্রথা অপরাধযোগ্য
জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আইনের ১৭নং ধারায় এই আইন লঙ্ঘনে ছ’মাসের জেল ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে৷ কারণ মানুষের ব্যক্তি অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ সামাজিক মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, ধর্মীয় স্থানে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নীচু জাত আর উঁচু জাতের মধ্যে বিভেদ করা অবৈধ৷ ১৯৭১ সালে আইনটি সংশোধন করে তার নাম দেওয়া হয় নাগরিক অধিকার সুরক্ষা আইন৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Seelam
দলিতরা কি মানুষ নয়?
মন্দির তো দূরের কথা, সম্প্রতি গুজরাট, উত্তর প্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু গ্রামে দলিত ও হরিজনদের কুঁয়ো থেকে জল নিতে বাধা দেওয়া হয় গ্রামের মোড়লদের নির্দেশে৷ এ নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিলে, পুলিশ পাহারা বসাতে হয়৷ শেষে দলিতরা নিজেদের জন্য আলাদা কুঁয়ো খুঁড়ে নেন৷ প্রচণ্ড খরা সত্ত্বেও গুজরাটের মেহসানা জেলার ডজন খানেক মহিলা কাকুতি-মিনতি করলেও তঁদের কুঁয়ো থেকে জল নিতে দেওয়া হয়নি৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
লিঙ্গ বৈষম্য নিরোধক আইন
দেব-দেবীর মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার না থাকায়, তার বিরুদ্ধে নারীবাদী সংগঠনগুলি সোচ্চার সর্বদাই৷ কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষের মন এতে টলেনি৷ ধর্মগুরুদের মতে, প্রাচীনকাল থেকেই মাসিকের সময় মেয়েদের ‘অশুচি’ বলে গণ্য করা হয়৷ তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে মুম্বই হাইকোর্ট মন্দির প্রবেশাধিকার আইন ১৯৪৭ অনুসারে রায় দেয় যে, মন্দিরে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না৷
ছবি: Reuters/Anindito Mukherjee
মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে আবারো আপিল
তৃপ্তি দেশাইয়ের নেতৃত্বেই একদল মহিলা মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরে একটি শনি মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করেন৷ মন্দির কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে, তাঁরা সেখানেই ধর্ণা দেন৷ মুম্বইয়ের রাস্তায় মন্দিরে মেয়েদের অবাধ প্রবেশাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়৷ এরপর কিছু কিছু মন্দিরে নারীরা প্রবেশাধিকার পেলেও, কেরালার সবরিমালা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি মন্দির কর্তৃপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
মুসলিম শরিয়ত বিধি ১৯৩৭
‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ নিয়ে সরকার দোটানায়৷ সংবিধানে নারী-পুরুষকে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু মুসলমানদের জন্য সামাজিক বা পারিবারিক বিবাদে কোরান-ভিত্তিক শরিয়ত আইনই শেষ কথা৷ তবে মুসলিম নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষদের এক তরফা তিন তালাকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে৷ আওয়াজ তুলেছে বহুবিবাহ, তালাক ও খোরপোষের দাবিতে৷ একদিকে সংবিধান, অন্যদিকে মুসলিম পুরুষ সমাজ৷ বিযয়টি তাই আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শাহ বানুর পর সায়রা বানু
ভারতের দেরাদনের ৩৫ বছরের সায়রা বানু সম্ভবত প্রথম মুসলিম মহিলা, যিনি সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক প্রথা রদ করার আর্জি জানিয়েছেন৷ সায়রা বানু উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়িতে গেলে তাঁর স্বামী রিজওয়ান আহমেদ এলাহাবাদ থেকে তালাকনামা পাঠিয়ে ১৫ বছরের দাম্পত্যজীবনের ইতি টানতে চান৷ বিয়ের পরে বহবার গর্ভপাতে আজ অসুস্থ সায়রা৷ তারপরও এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে মরিয়া সায়রা বানু৷
ছবি: Reuters
14 ছবি1 | 14
কাজেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার নির্দিষ্টভাবে কোনো সম্প্রদায়কে উত্যক্ত করতে বা তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে কিছু করার চেষ্টা করছে না৷ তারপরও প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন হঠাৎ দীর্ঘ ৬২ বছর পর বিষয়টা নিয়ে তৎপরতার দরকার হলো? এটা জেনেও যে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ কার্যত মৌচাকে ঢিল মারার সামিল! এখানেও বোঝাপড়ার অভাব ঘটছে যে মোদী সরকারই বুঝি এমনটা করতে চাইছে৷ কিন্তু প্রসঙ্গটা আসলে উত্থাপন করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷
সর্বোচ্চ আদালতের তাগাদাতেই কেন্দ্র সরকার নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, হ্যাঁ, তাদের অবশ্যই সায় আছে অভিন্ন দেওয়ানি আইনে৷ ঘটনাচক্রে ভারতীয় জনতা পার্টি বহু দিন ধরেই এই অভিন্ন বিধির পক্ষে৷ ১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, এটাও ছিল তাদের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি৷
কিন্তু সরকার নয়, বিচারবিভাগ এবার প্রশ্নটা তুলেছে৷ কেন? কারণ সারা বছর অসংখ্য মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াচ্ছে, যেখানে মুসলিম নারীরা তালাকের পর খোরপোষ না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ তাঁরা মনে করছেন, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের বেঁধে দেওয়া আইন পুরুষদের প্রতি চরম পক্ষপাতদুষ্ট৷ মুসলিম মহিলাদের স্বার্থ সেই আইনে আদৌ সুরক্ষিত নয়৷ তারই সুযোগ নিয়ে মুসলিম পুরুষরা যথেচ্ছ বিয়ে করে, বিচ্ছেদ ঘটায় এবং পরবর্তীতে প্রাক্তন স্ত্রীদের ভরণপোষণের কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্তর নির্বিশেষে বহু মুসলিম মহিলা এই বৈষম্যের শিকার হয়েই চলেছেন৷
ভারতের একাধিক নারী অধিকার সুরক্ষা সংগঠন এই বিতর্কে নিজেদের যুক্ত করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্যও বিশেষ প্রনিধানযোগ্য৷ তারা বলছে, অভিন্ন দেওয়ানি আইন কোনো বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসনের বিরোধিতা করতে নয়, বরং নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রথার বিলোপ ঘটাতে৷ এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, যদি থাকত, তা হলে একাধিক ইসলামি দেশ নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে নারী অধিকার সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করত না৷
মোদী সরকারের আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ, মন্ত্রী এবং আইনজীবী অরুণ জেটলি থেকে শুরু করে সকলেই এই একটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন, যে ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে এরকম বিচ্যুতি আর চলতে দেওয়া যায় না৷ এটা সময়ের দাবি৷
বিবাহবিচ্ছেদ আইন
বাংলাদেশে দিন দিন বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে৷ বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের নাগরিকরা আইন অনুযায়ী কীভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন, সেই তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: privat
ইসলাম
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী, কাজীর মাধ্যমে তালাক দিতে হবে এবং তালাকের নোটিশ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা সিটি কর্পোরেশনকে পাঠাতে হবে৷ মুখে তালাক দিলে সেটি কার্যকর হবে না৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সমান নয়
স্বামী কোনো কারণ ছাড়া স্ত্রীকে তালাক দিতে পারলেও, স্ত্রী সেটা করতে পারেন না৷ এর জন্য আইনে কতগুলো কারণ উল্লেখ আছে৷ শুধুমাত্র সেসব কারণেই স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কয়েকটি কারণ
স্বামী চার বছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকলে, দুই বছর স্ত্রীর ভরণপোষণ না দিলে বা ব্যর্থ হলে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে, সাত বছরের বেশি কারাদণ্ড পেলে, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, বিয়ের সময় স্বামী পুরুষত্বহীন থাকলে, দুই বছর ধরে অপ্রকৃতিস্থ থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ বা মারাত্মক যৌনরোগে আক্রান্ত থাকলে৷ বাকি কারণগুলো জানতে উপরে (+) বাটনে চাপ দিন৷
ছবি: LIB
হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধ
একটা সময় ছিল যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা আবার বিয়ে করতে চাইলে, স্ত্রীকে আগে হিল্লা বিয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হত৷ এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের ব্যক্তি (স্বামী) স্ত্রীকে তালাক দিলে বা মারা গেলে স্ত্রী পুনরায় প্রথম স্বামীকে বিয়ে করতে পারতেন৷ মধ্যবর্তীকালীন এই বিয়ের নামই হচ্ছে ‘হিল্লা’ বিয়ে৷ তবে বর্তমানে এটি নিষিদ্ধ৷
ছবি: infokosh.gov.bd
হিন্দু ধর্ম
সনাতন হিন্দু আইনে সরাসরি বিবাহবিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই৷ তবে ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে আনা অভিযোগ প্রমাণ হলে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব৷ এছাড়া ‘স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ীও ডিভোর্স সম্ভব৷ তবে বাংলাদেশে এ সব আইন প্রযোজ্য নয়৷ স্ত্রী যদি একান্তই স্বামীর সঙ্গে থাকতে না চান তাহলে তিনি অন্য কোথাও আলাদা থাকতে পারেন৷ এক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে খোরপোশ পাওয়ার অধিকারী৷
ছবি: AFP/Getty Images/P. Singh
খ্রিষ্টান ধর্ম
বাংলাদেশে এক্ষেত্রে ১৮৬৯ সালের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট’ মানা হয়৷ তবে ক্যাথলিকরা এই আইনের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন না, কারণ ক্যাথলিকরা বিবাহবিচ্ছেদ মানেন না৷ তবে প্রোটেস্ট্যান্টরা এই আইনের আওচায় বিবাহবিচ্ছেদ করে থাকেন৷ এই আইনে অবশ্য বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে স্বামীর মতো সমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: privat
6 ছবি1 | 6
এ প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলার উদাহরণ দেওয়া যায়৷ ১৯৯৫ সালে সরলা মুদগল বনাম ভারত সরকার মামলা৷ সরলা মুদগলের হিন্দু স্বামী দ্বিতীয় একটি বিয়ে করবেন বলে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন হিন্দু বৈবাহিক আইনে তাঁর প্রথম বিবাহটি বিচ্ছেদ না ঘটিয়েই৷ সুপ্রিম কোর্ট সেই দ্বিতীয় বিয়েটি অবৈধ ঘোষণা করে৷ কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ওই মামলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি না থাকার কারণে পুরুষতন্ত্র কীভাবে পরিস্থিতির অন্যায় সুযোগ নেয়৷ এছাড়া ১৯৮৫ সালের শাহ বানু মামলা এখনও অনেকেরই মনে আছে৷ বৃদ্ধা শাহ বানুকে তিন তালাক দিয়ে কার্যত রাস্তায় বের করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী৷ সেই সময়ও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, ভারতীয় দণ্ডবিধিতে খোরপোষ পাওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে একজন বিবাহবিচ্ছিন্ন মুসলিম নারীর৷ কিন্তু সেবারও বাধ সেধেছিল মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড৷ কাজেই এবারের আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই প্রশ্নে যে, ধর্মীয় বিধান আগে, না মানুষ!