মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নোটিশ দিল নির্বাচন কমিশন। ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু ভোট চাওয়ার অভিযোগে তাঁকে নোটিশ দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
গত ৩ এপ্রিলের ঘটনা। তারকেশ্বরের সভায় বিজেপি-কে রুখতে সংখ্যালঘু ভোট যাতে ভাগ না হয়, তার আবেদন করেছিলেন মমতা। তিনি বলেছিলেন, ''বিজেপি এলে মনে রাখবেন, সমূহ বিপদ। সব চেয়ে বেশি বিপদ আপনাদের।'' শুধু এটুকুই নয়, ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকির নাম না করে মমতা বলেছিলেন, ''সংখ্যালঘু ভাইবোন, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলছি, ওই ছেলেটা বেরিয়েছে বিজেপি-র টাকা নিয়ে, ওইটার কথা শুনে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করবেন না।''
এরপরেই ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়ার অভিযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুধবার নোটিশ দিয়েছে কমিশন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ, শুক্রবারের মধ্যে তাকে এর জবাব কমিশনের কাছে পাঠাতে হবে। মমতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জনপ্রতিনিধি আইন ভঙ্গ করেছেন। জনপ্রতিনিধি আইন অনুসারে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া যায় না। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানো যায় না। মমতাকে যে নোটিশ পাঠিয়েছে কমিশন, তাতে জনপ্রতিনিধি আইন ও নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার অভিযোগের জবাব চাওয়া হয়েছে। নিয়মানুসারে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রার্থীপদ পর্যন্ত খারিজ করে দিতে পারে কমিশন।
গত মঙ্গলবারই কোচবিহারে এসে মোদী বলেছিলেন, ''মমতাদিদি জনসভায় যা বলেছেন, তা আমি বললে আমাকে এতদিনে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ পেতে হতো। সংবাদপত্রে আমাকে আক্রমণ করা হতো। আপনি বলেছেন, মুসলিমরা একজোট হয়ে ভোট দাও। আমি যদি বলতাম, হিন্দুরা জোট বেঁধে বিজেপি-কে ভোট দিন, তা হলে কেমন হতো ভাবুন তো!''
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটের লড়াই
পশ্চিমবঙ্গে ভোটদাতাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম। একাধিক জেলায় অনেক আসনে ভোটের ফল প্রভাবিত করেন তারা।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
সব চেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদে
পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই কমবেশি মুসলিম ভোটদাতা আছেন। তবে সব চেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদে। সেখানে প্রায় ৬৭ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম। তারপরেই রয়েছে মালদহ। ৫১ শতাংশ। উত্তর দিনাজপুরে ৪৯ শতাংশ। কলকাতায় ২০ শতাংশ, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩৫ শতাংশ, উত্তর ২৪ পরগনায় ২৬ শতাংশের মতো মুসলিম ভোটদাতা আছেন।
ছবি: Reuters/R. De Chowdhuri
মুসলিম ভোটের দাবিদার
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোটের প্রধান দাবিদার হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা। গত নির্বাচনে মুসলিম ভোটের সিংহভাগ পেয়েছিলেন মমতাই। এবার বাম জোটও মুসলিম ভোট ফিরে পেতে চায়। ছবিতে জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন বাম জোটের শরিক দলের নেতা আব্বাস সিদ্দিকি।
ছবি: Naushad Bhai
আব্বাস সিদ্দিকি ভরসা
বামেদের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চায় আছে কংগ্রেস এবং আব্বাস সিদ্দিকির নবগঠিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি সম্প্রতি তার দল গঠন করেছেন। বাম ও কংগ্রেসের আশা, সিদ্দিকি মুসলিম ভোটের একটা অংশ জোটের দিকে টানতে পারবেন।
ছবি: Naushad Bhai
ওয়েইসি এখনো প্রার্থী দেননি
এমআইএম(মিম) নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ভালো ফল করেছিলেন। তিনি অনেক আসনে আরজেডি-কংগ্রেসের মুসলিম ভোটে ভাগ বসাতে পেরেছিলেন। তাতে অবশ্য নীতীশ কুমার ও বিজেপি-র জয়ের পথ প্রশস্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েও প্রথম দফার নির্বাচনে প্রার্থী দেননি তিনি।
ছবি: Imago/Hindustan Times/S. Mehta
ওয়েইসির দলে ক্ষোভ
পশ্চিমবঙ্গে মিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহিরুল হাসান পদত্যাগ করেছেন। ওয়েইসি প্রার্থী না দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের ১৩টি আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা ছিল। সেটাও ঘোষণা করা হয়নি। ওয়েইসির সভাও বাতিল হয়েছে। ফলে ওয়েইসি কী করবেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ছবি: Ians
তৃণমূলের আশা
তৃণমূল নেতাদের আশা, গতবারের মতো তারা এবারেও মুসলিম ভোটের সিংহভাগ পাবেন। তবে গতবারের তুলনায় মমতা এবার ১০ জন মুসলিম প্রার্থী কম দিয়েছেন। বিজেপি-র মোকাবিলায় তিনি হিন্দুত্বের তাসও খেলছেন। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, গত দশ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের জন্য অনেক কাজ করেছেন এবং করার চেষ্টা করেছেন।
ছবি: Indranil Aditya/NurPhoto/picture alliance
মুসলিম ভোট কোনদিকে
পশ্চিমবঙ্গে একসময় মুসলিম ভোট ভাগ হতো বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে। মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় তৃণমূল করার পর পরিস্থিতির বদলায়। বিজেপি-র দিকে মুসলিম ভোট বিশেষ যায় না। সে কথা মাথায় রাখলে মুসলিম ভোটদাতার কাছে বিকল্প তৃণমূল ও বাম জোট। দুই মুসলিম প্রধান জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদহ হলো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। তাদের জয় নির্ভর করছে, মুসলিমরা কতটা পাশে থাকবেন তার উপর। বাকি জেলাতে মুসলিম ভোট পাওয়ার ব্যাপারে তৃণমূল আশাবাদী।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
7 ছবি1 | 7
প্রবীণ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, কমিশনের এই ধরনের নোটিশ পাঠানোর এক্তিয়ার আছে এবং তা পাঠানো উচিত। তবে কমিশনের উচিত এরকম সব অভিযোগ নিয়ে একইভাবে তৎপর হওয়া। ডয়চে ভেলেকে সৌম্য বলেছেন, ''সম্প্রতি অসমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বললেন, আপনারা মোদীজির আত্মনির্ভর আসাম চান নাকি মৌলবী নির্ভর আসাম, তখন তো কিছু করা হয়নি! নন্দীগ্রামে যখন সাম্প্রদায়িক প্রচার হলো, তখনো কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমার মনে হয়, যখনই ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া হবে, তখনই কমিশনের তৎপর হওয়া উচিত।''
লেখক ও প্রবীণ সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, এতদিন সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলি বিজেপি-কে হিন্দুত্ববাদী বলে অভিহিত করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে , যারা নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলছেন, তারা সরাসরি মুসলিমদের কাছে ভোট দেয়ার আবেদন করছেন। ডয়চে ভেলেকে দীপ্তেন্দ্র বলেছেন, ''এভাবে কোনো সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া যায় না। মমতা সেদিন শুধু সংখ্যালঘুদের কাছে ভোট চাননি, তিনি হিন্দুদেরকেও হিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের কাছেও কিছু আবেদন জানিয়েছেন। ফলে দুই সম্প্রদায়ের কাছে আলাদা আলাদা কারণ দেখিয়ে তিনি ভোট চেয়েছেন।'' দীপ্তেন্দ্রর মতে, এটা ঠিক নয়। নির্বাচন কমিশনের কড়া ব্যবস্থা নেয়া উচিত।