জাতি-বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ও ইসলাম সম্পর্কে আতঙ্ক দূর করার লক্ষ্যে পথে নামলেন মুসলিম ও ইহুদিরা৷ অভিবাসন নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগ ও জার্মানির জাতীয়তাবাদী দল এএফডি-র উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সাইকেল যাত্রায় অংশ নিলেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
এক সাইকেল দুই সওয়ারি৷ একজন মুসলিম ইমাম ও আর একজন ইহুদি ধর্মযাজক৷ ইসলাম সহ নানা ধর্ম জাতির বিরুদ্ধে ক্রমশ বাড়তে থাকা হিংসার প্রতিবাদে রবিবার তাঁদের এই সাইকেল যাত্রায় অংশ নিলেন আরও বহু মানুষ৷ বার্লিনের এই যাত্রা শুরু হয় বেবেলপ্লাৎসে, হলোকাস্ট মেমোরিয়াল থেকে৷
এই বেবেলপ্লাৎসে ১৯৩৩ সালে নাৎসিরা ২০ হাজার বই পুড়িয়ে দিয়েছিল৷ মুসলিম ও ইহুদি ধর্মীয় নেতারা ছাড়াও খ্রিষ্টধর্মের ও সরাসরি ধর্মীয় নেতৃত্বে স্থানে নেই এমন মানুষেরাও যোগ দিয়েছিলেন৷
বার্লিনের ইমাম এন্ডার সেটিন বলেন, ‘‘আমাদেরই একতার নমুনা তুলে ধরতে হবে৷ এই যাত্রার মাধ্যমে আমরা মুসলিমদের বলতে চাই , আমরা বিদ্বেষ সহ্য করব না৷''
ধর্ম, টুপি এবং মাথা ঢাকার ঐতিহ্য
পৃথিবীর নারী-পুরুষদের অনেকেই ধর্মীয় কারণে মাথায় টুপি পরেন বা মাথা ঢাকেন৷ তবে ধর্মীয় বিধান ও আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী টুপি বা মাথাবন্ধনীর রয়েছে নানা ধরনের বৈচিত্র্য৷ এবারের ছবিগুলোতে সেই বৈচিত্র্যই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Dyck
ইয়ারমুকে
ইউরোপের ইহুদিরা ১৭ এবং ১৮ শতকে টুপি পরতে শুরু করে, যার নাম ইয়ারমুকে৷ ইহুদিদের ধর্মীয় আইন অনুযায়ী পুরুষ এবং ছেলেদের জন্য প্রার্থনা, সিনাগগ ও কবরস্থানে অবস্থানকালে এবং ধর্মীয় বিষয় পড়ার সময় এ টুপি মাথায় দেওয়া বাধ্যতামূলক৷
ছবি: picture alliance/dpa/W. Rothermel
মাইটার
রোমান-ক্যাথলিক চার্চের বিশপদের বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিধান করা হয় মাইটার নামের টুপি৷ লম্বা এ টুপির প্রচলন ১১ শতকে৷ এটি পেছনের দুটি রিবন দিয়ে বাঁধা থাকে, যা ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্টের প্রতীক৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Seeger
পাগড়ি
১৫ শতকে চালু হওয়া ভারতের পাঞ্জাবের শিখ ধর্মের অনুসারীরা ‘দাসতার’ নামের এই পাগড়ি ব্যবহার করেন৷ এটি সাধারণত পুরুষেরা তৈরি করে৷ ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী শিখ পুরুষেরা পাগড়ির নীচে তাদের চুল বাড়তে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Dyck
চাদর
ফারসি ভাষায় চাদর শব্দের অর্থ তাঁবু৷ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান মেয়েদের একটি বড় অংশ চাদর দিয়ে মাথা ঢাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Kappeler
সন্ন্যাসীনিদের মাথাবন্ধনী
সন্ন্যাসীনিরা সবসময় মাথাবন্ধনী পরে থাকেন৷ নবীন সন্ন্যাসীনিরা সাদা এবং প্রবীণরা কালো মাথাবন্ধনী ব্যবহার করেন৷ ধর্মীয় অবস্থান অনুযায়ী এই মাথাবন্ধনীর আকার বিভিন্ন রকমের হয়৷ কারোটা বেশ বড় হয়, যা মুখমণ্ডলসহ পুরো মাথা ঢেকে রাখে৷ আবার কারোটা খুব ছোট হয়, স্রেফ মাথার উপরের অংশ ঢেকে রাখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Baumgarten
স্কার্ফ বা হিজাব
মূলত একটি ধর্মীয় পোশাক হিসেবে পরিচিত, যা নিয়ে পুরো পৃথিবীতেই এখন তর্ক হচ্ছে৷ তুরস্ক বা আরবের মেয়েরা ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে এটির ব্যবহার করতো৷ পরে পুরো পৃথিবীতেই এটি ছড়িয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Schiffmann
শাইটেল
মূলত হাসিডিক মতাদর্শের ইহুদিরা এ ধরনের টুপি ব্যবহার করেন৷ হাসিডিক মতাদর্শের ইহুদিদের পশ্চিম ইউক্রেনে উত্থান হয় ১৭ থেকে ১৮ শতাব্দীর গোড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Y. Dongxun
বিরাশা
কাপড়, কার্ডবোর্ড এবং এক টুকরো রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরি ‘বিরাশা‘ ১২ শতাব্দীর রোমান ক্যাথলিক যাজকরা ব্যবহার করা শুরু করেন৷ জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সে এই টুপিটি চার কোণা ৷ তবে অনেক জায়গায় এটি তিনকোণা৷
ছবি: Picture-alliance/akg-images
ট্যাগেলমাস্ট
বিশেষ ধরনের মাথা ও মুখবন্ধনী৷ ১৫ মিটার লম্বা সুতি কাপড় দিয়ে তৈরি এই মুখবন্ধনী উত্তর আফ্রিকার মুসলমান পুরুষরা পরতেন৷
উত্তর অ্যামেরিকার রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত অ্যামিশরা এই ধরনের টুপি ব্যবহার করেন৷ সুইজারল্যান্ড এবং দক্ষিণ জার্মানির অ্যানাব্যাপ্টিস্ট আন্দোলনের পর অ্যামিশদের প্রথম প্রজন্ম ধর্মীয় সহিংসতার জের ধরে ১৮ শতকে অ্যামেরিকায় পালায়৷ তাঁদের মেয়েরা ঘরে বসে বনেট বুনেন৷ অ্যামিশ পুরুষেরা খড় বা অন্যকিছুর তৈরি হ্যাট পরেন৷
ছবি: DW/S. Sanderson
10 ছবি1 | 10
এন্ডারের সঙ্গে একই সঙ্গে সাইকেলে চড়েছিলেন রাব্বি ইলিয়াস দ্রায়৷ ইহুদি ধর্মীয় নেতা রাব্বি বলেন, সমাজ ও সাধারণ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা রুখতে হবে৷ তাই এন্ডার ও রাব্বি একসঙ্গে নিয়মিত বার্লিনের বিভিন্ন স্কুলে যান ও পড়ুয়াদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেন৷
জার্মানিতে কট্টর জাতীয়তাবাদী দল, অভিবাসন বিরোধী এএফডির প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে৷ গত বছরের সাধারন নির্বাচনে তারা ১২.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে৷ সাম্প্রতিককালে জার্মানিতে ইহুদি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে৷ কোথাও ‘কিপা' পরার জন্য ইহুদিরা আক্রান্ত হয়েছে, তো কোথাও হিজাবে মাথা ঢাকার জন্য মুসলিমরা৷
পিএস/ডিজি (এপি, এএফপি)
সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে দূর করা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আট নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কথা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সাদেকা হালিম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে৷ এছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করলে অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব৷ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে৷ আরেকটি বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধর্মের সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
গোলাম কুদ্দুস, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
কোনো ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না৷ পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে৷ তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেউ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে৷ দেশের প্রতিটি মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
আইনুন নাহার সিদ্দিকা, আইনজীবী
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সব রকমের রাজনৈতিক উস্কানি বন্ধ করতে হবে৷ আমরা যেন এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের পেছনে কখনো না লাগি৷ সবাই সবার ধর্মকে সম্মান করি৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
শেখ শাফায়াতুর রহমান, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কখনো শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা যাবে না৷ আমাদেরকে আমাদের বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
রেখা শাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে দেশের সর্বত্র সকল ধর্মের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ সবাই যেন সবার ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ এছাড়া সবাই মিলে একটি দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারলে সাম্প্রদায়িকতাও দেশ থেকে দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
খরাজ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা, পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ৮৫ শতাংশ মেকআপ আর্টিস্টই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের৷ কই, আমাদের তো সমস্যা হয় না! আমরা মন থেকে কোনও বিভেদে বিশ্বাস রাখি না৷ তাই নিজেদের মধ্যেও বিভেদ জন্মায় না৷ মনের অন্ধকার দূর করাটাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার৷
সত্যিকারের জ্ঞান মনের সংকীর্ণতা দূর করে৷ তাই শুধু ডিগ্রি দিয়ে লাভ নেই৷ জ্ঞানের আলো জ্বালাতে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে৷ সেটাই হবে আদর্শ জ্ঞাননির্ভর সমাজ৷ সেই সমাজ এমন মানুষ তৈরি করবে, যার মধ্যে উগ্রতা থাকবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
পতিতপাবন রায়, পিয়ারলেস, পশ্চিমবঙ্গ
ব্যক্তিগতস্তরে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু সমষ্টিগতস্তরে মানতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন৷ দেওয়ানি বিধির অধীনে সবাইকে রাখতে হবে৷ রাজনীতির অনুপ্রবেশ রুখে সবার জন্য সমান আইন প্রণয়ন দরকার৷ তবেই রাস্তা আটকে নামাজ পড়া বা মণ্ডপ তৈরি নিয়ে দাঙ্গা হবে না বা রক্তও ঝরবে না৷