ভারতে যারা বসবাস করেন, তাদের সকলের পূর্বপুরুষই এক। সকলেই হিন্দু। সেই অর্থে সকল ভারতীয় নাগরিকই হিন্দু। মুম্বইয়ের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ফের বিতর্কিত মন্তব্য করলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত। তার বক্তব্য নিয়ে ভারতীয় নাগরিক সমাজে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
মুম্বইয়ের মুসলিম বিশিষ্টজনেদের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন মোহন ভগবত। সেখানে সমাজে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলছিলেন তিনি। কট্টরবাদী সংগঠনগুলি থেকে কেন দূরত্ব তৈরি করা দরকার, সে বিষয়ে নিজের মতামত জানাচ্ছিলেন। এমনকী তালেবানের প্রসঙ্গও তোলেন বক্তৃতায়। এ সব বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই ভগবত দাবি করেন, ''ভারতের ইতিহাস সহনশীলতার। এদেশের পূর্বপুরুষরা সকলেই হিন্দু ছিলেন। ইসলাম এসেছিল আক্রমণকারীদের সঙ্গে। তার আগে সকলেই হিন্দু ছিলেন।'' ভগবতের দাবি, সেই বিচারে এখনো ভারতের সমস্ত নাগরিকই হিন্দু।
ধর্মের নামে মন্দির, মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় হামলা
প্রাচীন স্থাপনা ও অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে চলেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস৷ মসজিদের ওপরও হামলা হয়েছে৷ উপমহাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ইতিহাসও দীর্ঘ৷ ধর্মের নামে এমন ধ্বংসের ‘খেলা’ থামবে কবে?
ছবি: Reuters
মালিতে ধ্বংসলীলা
এক সময় মালির টিমবাকটু শহরের অন্য নাম ছিল ‘মরুদ্যানের মুক্তা’৷ সেই শহরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেই চলেছে সেখানকার ইসলামি জঙ্গি সংগঠন৷ ২০১২ সালে শহরটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলমানদের গড়া অনেক স্থাপত্য নিদর্শনও ধ্বংস করেছে তারা৷ সম্প্রতি শহরটিকে জঙ্গিদের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত করার দাবি করেছে মালির সেনাবাহিনী৷
ছবি: Getty Images/AFP
সন্ত্রাসপ্রীতি এবং জ্ঞানভীতি
শুধু স্থাপনা বা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনই নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিও ধ্বংস করেছে জঙ্গিরা৷
ছবি: DW/P. Breu
তথাকথিত আইএস-এর হামলা
সিরিয়ার পালমিরা শহরের প্রায় ২,০০০ বছরের পুরনো স্থাপনাগুলোও রেহাই পায়নি৷ সে দেশে চলছে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর ধ্বংসযজ্ঞ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পালমিরার মন্দির ধ্বংস
এক সময় সিরিয়ার হোমস নগরীর এই স্থাপনাটিকে নিয়ে গর্ব করত সিরিয়া৷ এটি এক সময় ছিল মন্দির৷ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন এই উপসনালয় দেখে পর্যটকরা মুগ্ধ হতেন৷ আইএস-এর হামলায় স্থাপনাটি এখন ক্ষতবিক্ষত৷
ছবি: Reuters/Stringer
ধ্বংস যখন প্রচারণার হাতিয়ার
ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক সহাবস্থানকে হুমকির মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টায় আইএস অক্লান্ত৷ নৃশংসতা, বর্বরতা ক্রমেই আইএস-এর প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠছে৷ এভাবে পেট্রল ঢেলে স্থাপনা পোড়ালে সংবাদমাধ্যম লুফে নেয় খবর, খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত জঙ্গিরাও পেয়ে যায় তাদের কাঙ্খিত প্রচার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আয়ের উৎস
সিরিয়া ও ইরাকের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ শুধু ধ্বংসই করে না, অনেক সময় কদর বুঝে সেগুলো চোরাপথে চড়াদামে বিক্রিও করে আইএস৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করার অভিযোগ আছে আইএস-এর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/IS/Internet
আফগানিস্তানে তালেবান বর্বরতা
আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো৷ ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Ahmed
আফ্রিকায় হামলার শিকার মসজিদ
মসজিদও অনেকক্ষেত্রে তথাকথিত ধর্মীয় উন্মত্ততার শিকার৷ ২০১৫ সালে মুসলমানদের উপাসনালয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলার খবর আসে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান থেকে৷ খ্রিষ্টান-মুসলিম দাঙ্গায় সেখানে অন্তত ৪১৭টি মসজিদ আংশিক অথবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে বলেও দাবি করা হয়৷
ছবি: ISSOUF SANOGO/AFP/Getty Images
গির্জায় হামলা
ইসলামি জঙ্গিরা আফ্রিকা অঞ্চলে গির্জাতেও প্রায়সময়ে হামলা চালায়৷ হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে৷ ওপরের ছবিটিতে কেনিয়ার এক গির্জায় হামলার পরের দৃশ্য৷
ছবি: dapd
ভারতের ইতিহাসের কালো অধ্যায়
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের ইতিহাসের ‘কালো দিন’৷ ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার বাবরি মসজিদে সেদিনই হামলা চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে হিন্দু মৌলবাদীরা৷ মুঘল সম্রাট বাবরের নামে গড়া সুপ্রাচীন এই মসজিদের ওপর হামলার ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
বাংলাদেশে প্রতিবছরই মন্দিরে হামলা
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মূলত একাত্তরের মুক্তযুদ্ধের সময় থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুরা হামলা, নির্যাতনের শিকার৷ তবে মন্দিরে মুর্তি ভাঙা, মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটে প্রতিবছর৷ বৌদ্ধ মন্দিরেও হামলা হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলার কারণ ধর্মীয় উগ্রতা৷ সারা বিশ্বে ধর্মের নামে ধর্মীয় উপাসনালয় বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপর হামলা থামবে কবে?
ছবি: Reuters
11 ছবি1 | 11
এর আগেও এধরনের উসকানিমূলক কথা বলেছেন মোহন ভগবত। ভারত এবং ইন্ডিয়াকে আলাদা চোখে দেখার কথা বলেছেন। তার এদিনের বক্তব্য নিয়ে খোদ আরএসএস-এর মধ্যেই দ্বিমত আছে। সাবেক আরএসএস নেতা কে এন গোবিন্দাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, মোহন ভগবতের এ ধরনের কথা সম্পূর্ণ অর্থহীন। তাঁর বক্তব্য, ''অতীতই যদি খুঁজে বার করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে রাবণ এবং বশিষ্টমুণির ডিনিএ এক। তার মানেই কি তারা এক হয়ে গেলেন?'' তার কথায়, যদি দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে এই চোখেই দেখা হবে, তাহলে বার বার তাদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশকারীর অভিযোগ আনা হয় কেন? কেন গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে এক চোখে দেখা হয় না। অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়?
মোহন ভগবতের এই বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট রাজনীতি আছে বলে মনে করেন ইতিহাসের অধ্যাপক এবং গবেষক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বক্তব্য, ''ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস দীর্ঘ। আরএসএস তা যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে, তা অনৈতিক। এই ভূখণ্ডে শতাব্দী ধরে মুসলিমরা বসবাস করছেন। সেটা মাথায় রেখেই আলোচনা হওয়ার কথা। পিছনে তাকালে তো এপ, বনমানুষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়!'' অনির্বাণের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার বৈচিত্র্য। ঐক্য কিংবা সম্প্রীতি তৈরি হবে সেই বৈচিত্র্যকে উদযাপন করলে। ভগবত ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটেছেন।
মোহন ভগবতের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার শরদ গুপ্তা। মুম্বই থেকে তিনি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। আরএসএস জাতীয়তাবাদী মুসলিমের একটি ব্লক তৈরি করতে চাইছে। যাদের সামনে রেখে তারা নিজেদের হিন্দুত্ববাদী ভাবনাটিকে মুসলিম সমাজেও ছড়িয়ে দিতে চাইছে। সে জন্যই এ ধরনের মন্তব্যের জন্য ভগবত মুসলিমদের অনুষ্ঠান বেছে নিয়েছেন।''
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, মোহন ভগবত যথেষ্ট ভেবে-চিন্তেই এ কাজ করেছেন। সামনে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। সেখানে বিভাজনের রাজনীতি খুব চড়া সুরে বাঁধা। বিজেপি সেখানে বরাবরই হিন্দুত্ববাদী তাস খেলার চেষ্টা করে। এবারও করছে। সেই বিষয়টিকেই আরেকটু উসকে দিয়েছেন ভগবত। এ নিয়ে রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা হলে ভোটে তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন তারা।