বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে৷ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত কয়েক সপ্তাহে ধর্ষণের মামলার বেশ কয়েকজন আসামি ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷ মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচার নিশ্চিত না করে ক্রসফায়ার মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার (২৪.০৪.১৮) ভোররাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালী-পেকুয়া এলাকায় র্যাব-এর সঙ্গে ক্রসফয়ারে আব্দুল হাকিম মিন্টু (৩০) নামে শিশু ধর্ষণ মামলার এক আসামি নিহত হয়৷ র্যাব জানিয়েছে, ঐ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রথমে তাদের গোলাগুলি হয়৷ পরে আব্দুল হাকিম মিন্টুর লাশ পাওয়া যায়৷ র্যাব-এর কথা অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও দু'টি গুলির খোসা উদ্ধার করে তারা৷
নিহত আব্দুল হাকিম মিন্টু গত ১৮ এপ্রিল বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নে এলাকায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ১০ বছরের একটি শিশুর ধর্ষণ মামলার আসামি৷
গত ২১ এপ্রিল রাতে সাতক্ষীরা কলারোয়ায় শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি সোহাগ হোসেন পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়৷ সে কলারোয়া উপজেলার কেড়াছাগাছি ইউনিয়নের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ন'বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করেছিল বলে জানায় পুলিশ৷
৯ এপ্রিল যাশোরে র্যাব-এর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে শিশু ধর্ষণ মামলার আরেক আসামি আল আমিন ওরফে বাবু৷ যশোর সদর উপজেলার খোলাডাঙ্গা এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানায় ব়্যাব৷ তার বিরুদ্ধে গত ৩০ মার্চ আট বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করার অভিযোগে মামলা আছে৷ ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ানশুটার গান, এক রাউন্ড গুলি ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয় বলে খবর৷
‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হলো অপরাধ শনাক্ত করা, তদন্ত করা এবং অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা, তাই কোনোভাইে ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্য নয়’
গত ৯ মার্চ ভোর রাতে আশুলিয়ায় ক্রসফায়ারে ধর্ষণ মামলার আসামি রুবেল নিহত হয়৷ রুবেল সাভারে একটি বাসে তরুণী ধর্ষণ ও চালক হত্যা মামলার প্রধান আসামি বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
গত বছরের ১৭ অক্টোবর ভোর রাতে কক্সবাজারে শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি সেলিম র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়৷ র্যাব জানায়, সেলিম ঐ বছরের ২৩ আগস্ট কক্সবাজার বিমানবন্দর রোডের ফিশারিঘাট এলাকায় তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছিল৷ সেলিমকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযোন চালালে গোলগুলিতে সে নিহত হয়৷ ঘটনাস্থল একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি ওয়ান শুটার গানও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় ব়্যাব৷
এদিকে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন খোদ সংসদেই৷ জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ গত ১০ এপ্রিল সংসদে এই দাবি জানান৷ তিনি সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় দেশে সম্প্রতি ‘গণধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার' বিষয়টি তুলে ধরেন৷ এরপর গত মার্চ মাসে আশুলিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে ধর্ষণের আসামি নিহত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘ন'বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে পালিয়ে গিয়েছিল সে৷ সেই ধর্ষণকারীর সাথে র্যাব-এর বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে৷ র্যাব-এর দু'জন আহত হয়েছে৷ ধর্ষক নিহত হয়েছে৷ এটাই জনগণ দেখতে চায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘প্রতিদিনই বাসে ধর্ষণ হবে আর আপনি আইনের আশ্রয় নেবেন? এভাবে চলতে পারে না৷ মানুষ দেখতে চায়, এই মুহূর্তে বিচার হবে কি হবে না৷'' তিনি অবশ্য একইসঙ্গে ধর্ষণ মামলার বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালতের কথাও বলেন৷
‘শতকরা মাত্র তিনভাগ মামলায় আসামির শাস্তি হয়, নানা পর্যায়ে প্রভাবশালীদের ছাড়ও দেয়া হয়’
তবে ধর্ষণের মামলার আসামিদের ক্রসফায়ারে দেয়ার বিরোধিতাকরেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজ্ঞরা৷ তাঁরা বলছেন, ‘‘একটা অপরাধ কমাতে গিয়ে আরেকটা অপরাধ করা হচ্ছে৷ কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাই অগ্রহণযোগ্য৷ তাছাড়া এতে ধর্ষণ কমবে না৷ বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে তবেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷''
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধর্ষণের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ও তদন্তে অনীহা দেখতে পাই আমরা৷ বিচারেও তেমন অগ্রগতি নেই৷ শতকরা মাত্র তিনভাগ মামলায় আসামির শাস্তি হয়৷ নানা পর্যায়ে প্রভাবশালীদের ছাড়ও দেয়া হয়৷ বাস থেকে নেমে এক নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেন৷ অথচ পুলিশ বললো, তদন্ত ছাড়া তাকে আটক করা যাবে না৷ এছাড়া মামলা প্রমাণেও আছে নানা জটিলতা৷ এ সব কারণে ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়৷ ফলে ধর্ষণ বেড়ে চলেছে৷ ধর্ষক অপ্রতিরোধ হয়ে উঠছে৷ তাই একমাত্র বিচার নিশ্চিত করা গেলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷''
মিয়ানমার সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে গত আড়াই মাসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শিশুরা৷ জন ওয়েনস এর ছবিতে উঠে এসেছে সেইসব দুর্দশার কিছু কথা৷
ছবি: DW/J. Owens
গুলি আর ছুরিকাঘাত
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়েছে৷ তাদেরই একজন মোহাম্মদ বেলাল৷ দৌড়ে পালাতে পেরেছিল ১০ বছর বয়সি এই কিশোর৷ সে জানায়, ‘‘সেদিন সেনাবাহিনী এসে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়৷ আমার মা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসময় তাঁকে গুলি করা হয়৷ আমার বাবা হাঁটতে পারছিলেন না, তারা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে৷ আমি নিজ চোখে এসব দেখেছি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
আতঙ্কগ্রস্ত
মোহাম্মদ বেলালের বোন নূরও হত্যাযজ্ঞ দেখেছে৷ নিঃসঙ্গ হয়ে সে আর তার ভাই এখন বাংলাদেশে শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে৷ এখানে সে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে এবং খেলতে পারছে৷এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য৷ মিয়ানমারে থাকার সময় তাদের দুই ভাই-বোনকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো৷ তারপরও সাম্প্রতিক এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না সে৷ ‘‘আমি আমার বাবা-মা, বাড়ি আর দেশ, সবকিছুই ভীষণ মিস করছি,’’ জানায় নূর৷
ছবি: DW/J. Owens
গভীর সঙ্কট
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলছে এই সঙ্কট৷ সংঘাতে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে৷ সাম্প্রতিক সেনা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ১২ বছর বয়সি রহমান বলে, ‘‘তারা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অসুস্থ ছিল বলে আমার মা পালাতেও পারেনি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশুদের বাঁচাও
বাবা-মাকে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর দিলু আরা তার বোন রোজিনার সাথে পালায়৷ এখন ক্যাম্পে আছে ৫ বছর বয়সি এই শিশু৷ ‘‘আমি খুব কাঁদছিলাম আর পুরোটা সময়ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেট উড়ে যাচ্ছিল৷ কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি,’’ বলে শিশুটি৷ বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে আসা এই শিশুদের সাহয়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন৷ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শতকরা ৬০ ভাগই শিশু৷
ছবি: DW/J. Owens
পশুদের মতো শিকার
জাদেদ আলমও বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে এসেছে৷তবে ভাগ্য ভালো বলে সে তার চাচীকে সাথে পায়৷চাচীই এখন তার দেখাশোনা করছেন৷ সে বলছিল ‘মান্দি পাড়া’ নামে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে সে৷ ফুটবল খেলতেও সে খুব পছন্দ করতো৷ তবে সেনা অভিযানের পর থেকে সবকিছুই বদলে যায়৷ সে জানায়, ‘‘তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলে৷ আমি আমার বাবা-মা’র সাথে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, এমন সময় তাঁদেরকে গুলি করে সেনারা৷ সাথে সাথে মারা যায় তারা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশু অপহরণ
এসব ঘটনার সময় সব পরিবারকেই যে আলাদা হতে হয়েছে, তা নয়৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রহমান আলী নামে এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পে আছেন৷ তবে এখন তিনি তার ১০ বছর বয়সি ছেলে জিফাদকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷ ক্যাম্প এলাকায় প্রায় সারা বছরই শিশু অপহরণের গুজব শোনা যায়৷ রহমানের আশংকা, তাঁর ছেলেও পাচারকারীদের হাতে পড়েছে৷ ‘‘আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না৷ আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি,’’ বলে রহমান৷
ছবি: DW/J. Owens
‘আমি স্বাভাবিক নেই’
যখন গুলি শুরু হয়, তখন সকিনা খাতুন তাঁর বাচ্চাদের বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে৷ তারপরও ১৫ বছরের ইয়াসমিন আর ২০ বছরের জামালিকে বাঁচাতে পারেননি৷ ঘটনার সময় তারা পাশের গ্রামে ছিল৷ সকিনা বলছিল, ‘‘দাদা-দাদীর সামনে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ আমি এতটাই অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছি যে, এই কষ্টও অনুভব করতে পারছি না৷ তাই এই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক নেই৷’’ দুই সন্তানকে হারালেও বাকি নয় জনকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/J. Owens
হামলা, ধর্ষণ এবং লুটপাট
ইয়াসমিনের বয়স ১৫-র কাছাকাছি৷ তবে তাকে তার চেয়েও কম বয়সি বলে মনে হয়৷ গ্রামে থাকার সময় সে মার্বেল খেলতো আর বাড়ির কাছের মাঠে খেলতো৷ এখন অবশ্য ভিন্ন স্মৃতি তাড়িত করছে তাকে৷ মিয়ানমারের সেনারা তার বাবা ও ভাইদের প্রথমে মারধর ও পরে হত্যা করে৷ একদল সেনা তাকে ধর্ষণও করে৷ এখন ইয়াসমিন কেবল এটুকু বলতে পারে,‘‘আমার শরীরে ভীষণ ব্যথা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
8 ছবি1 | 8
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হলো অপরাধ শনাক্ত করা, তদন্ত করা এবং অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা৷ বিচারকের কাজ তাদের নয়৷ বিচারকের কাজ বিচারকের৷ তাই কোনোভাইে ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা অব্যাহত থাকলে মনে হাতে পারে যে বিচারালয়ের প্রয়োনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে৷ তাছাড়া এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এতটা জবাবদিহিতার বাইরে চলে যায় যে তারা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে৷ সমাজে যারা রাজনৈতিক, আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে শক্তিশালী, তারা বিচার এড়াতে পারে৷ ফলে সমাজে যে কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যায় এই ধারণা গড়ে উঠেছে৷ তাই ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার পথ হলো বিচার ব্যবস্থাকে কার্যকর করা৷''
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷