ইরাকের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী একটি সম্প্রদায় ইয়াজিদি৷ ২০১৪ সালে তাঁদের উপর হামলা চালায় তথাকথিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
বিজ্ঞাপন
ইসলাম ধর্মের সঙ্গে ইয়াজিদিদের অনুসরণ করা ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য থাকার অভিযোগে আইএস ইয়াজিদি সম্প্রদায়কে সমূলে উৎপাটন করতে চেয়েছিল৷ তাই তারা ইয়াজিদি পুরুষদের হত্যা করেছে, আর কিশোর ও তরুণদের জোর করে আইএস যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করেছে৷ এছাড়া নারী ও তরুণীদের যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহার করেছে আইএস জঙ্গিরা৷
এসব কারণে ইয়াজিদি নারীদের গর্ভে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে তাদের সমাজে গ্রহণ করা হবে না, বলে শনিবার জানিয়েছে ইয়াজিদিদের ‘সুপ্রিম স্পিরিচুয়াল কাউন্সিল'৷
এই সিদ্ধান্তের কারণে ধর্ষণের কারণে জন্ম নেয়া শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷
জানা গেছে, যৌন দাসী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া প্রায় তিন হাজার ইয়াজিদি নারী বর্তমানে সন্তানসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে৷ এদের মধ্যে একটি অংশ জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলে গেছেন৷ এছাড়া কেউ কেউ সন্তানদের ছেড়ে ইয়াজিদি সমাজে ফিরে গেছেন৷ বাকি যাঁরা এখনো শিবিরে আছেন, তাঁরা কী করবেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷
ইয়াজিদিদের নিয়ম অনুযায়ী, ইয়াজিদিও নন-ইয়াজিদির মধ্যে বিয়ে ও সন্তান ধারণের বিষয়টির স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷ ফলে আইএস জঙ্গিরা যেহেতু ইয়াজিদি গোত্রের কেউ নন, সে কারণে ইয়াজিদি সুপ্রিম কাউন্সিল ধর্ষণের কারণে জন্ম নেয়া শিশুদের মেনে নিতে চাইছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
এছাড়া ইয়াজিদিদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘ইয়াজদা'র উপ-পরিচালক আহমেদ বুর্জুস বলছেন, ইয়াজিদি গোত্রের জন্য অন্যতম বেদনার বিষয় হচ্ছে, এই শিশুরা এমন সব ব্যক্তির কারণে জন্মেছে, যারা কিনা ইয়াজিদি গোত্রের উপর গণহত্যা চালিয়েছে, ঘরবাড়ি লুট করেছে৷
অত্যাচারিত ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন আশা
ইরাকে গড়ে তোলা হয়েছে তখাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নির্যাতনের শিকার ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার৷ সে অঞ্চলে এমন চিকিৎসাকেন্দ্র এটাই প্রথম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
এক নির্যাতিতা
ছবির এই ইয়াজিদি নারীর নাম পেরভিন আলি বাকু৷ ২৩ বছর বয়সি পেরভিনকে তাঁর তিন বছরের মেয়েসহ ধরে নিয়ে গিয়েছিল আইএস৷ দু’বছরেরও বেশি সময় অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে তাঁকে৷ এখন তিনি ইরাকের এক শরণার্থী শিবিরে৷ আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত৷ তবু আতঙ্ক কাটেনি৷ এখনো কেউ একটু জোরে কথা বললেই মনে হয় এই বুঝি বর্বর লোকগুলো এলো, এই বুঝি আবার শুরু হলো অত্যাচার-নির্যাতন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
যে কারণে স্বস্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকি সেনাবাহিনীর আক্রমনে আইএস অনেকটাই দিশাহারা৷ পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে তারা৷ তাদের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে অনেক ইয়াজিদি নারী৷ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে জার্মানির বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য৷ রাজ্যটি ইতিমধ্যে আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত ১১শ ইয়াজিদি নারীকে জার্মানিতে নিয়ে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
শরণার্থী শিবিরে বাড়ছে ইয়াজিদি নারী
আইএস-এর কাছ থেকে মু্ক্ত হয়ে প্রায় নিয়মিতই ইয়াজিদি নারীরা আসছেন শরণার্থী শিবিরে৷ জার্মানিতে অবস্থানরত ইয়াজিদিদের উদ্যোগে অত্যাচারের শিকার ওই নারীদের কেউ কেউ আবার আশ্রয় পাচ্ছেন জার্মানিতে৷ জার্মানিতে প্রায় এক লক্ষ ইয়াজিদির বসবাস৷ তাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে ইয়াজিদি নারীদের নিয়ে আসার জন্য ইতিমধ্যে ৯ কোটি ৫০ লক্ষ ইউরোর বাজেট অনুমোদন করেছে বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্যের সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
তাঁদের কোনো চিকিৎসা নেই
মোসুলে আইএস কোণঠাসা হয়ে পড়ায় প্রতিদিনই সেখান থেকে ইয়াজিদিরা ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে আসছেন৷ মোসুল থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের এই শরণার্থী শিবিরে তেমন কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই৷ অত্যাচারের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে ফেরা নারীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসারও ভালো ব্যবস্থা নেই৷ ৫৫ লাখ কুর্দির এই অঞ্চলে আছে মাত্র ২৬ জন মনরোগ চিকিৎসক৷ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ইয়াজিদি নারীদের চিকিৎসা করছেন তাঁরা৷
অবশেষে আশার আলো
বয়স যখন মাত্র ছয়, তখনই ইরাক ছেড়ে জার্মানিবাসী হয়েছিলেন ইয়াজিদি ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান৷ ইরাকের ডোহুকে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার গড়ে তোলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
প্রশিক্ষণের সুযোগ
ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আগামী তিন বছরে ইরাকের ৩০ জন সাইকোথেরাপিস্টকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে৷ আগামী দশ বছরে অন্তত হাজারখানেক প্রশিক্ষিত সাইকোথেরাপিস্ট তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ধীরে ধীরে উন্তত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
পাশে দাঁড়ানোটা দায়িত্ব
এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ইয়াজিদি নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন কিজিলহান৷ তাঁদের কাছ থেকে জেনেছেন নির্যাতনের ভয়ংকর সব কাহিনি৷ জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান জানালেন, তাঁর কাছে অসহায় ওই নারীদের সহায়তা করা এখন অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
7 ছবি1 | 7
আহমেদ বুর্জুস বলেন, ইয়াজিদি গোত্রের অনেকে মনে করেন, এই শিশুরা আসলে ভবিষ্যতে আইএস-এর নির্যাতনের শিকারদের প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে৷ এছাড়া ইরাকের আইনের কারণে এই শিশুদের ইয়াজিদি হিসাবে নিবন্ধনও কঠিন হবে৷ কারণ, আইন বলছে, কোনো শিশুর মা-বাবার একজন যদি মুসলিম হয়, তাহলে সেই শিশুকে মুসলমান হিসেবে নিবন্ধন করা হবে৷
অ্যাক্টিভিস্টরা যা বলছেন
নোবেলজয়ী ইয়াজিদি অ্যাক্টিভিস্ট নাদিয়া মুরাদ বলছেন, ধর্ষণের শিকার মায়েরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ফিরবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তাঁদের পরিবারই নিতে পারেন৷ এক্ষেত্রে অন্যদের সিদ্ধান্ত দেয়ার কোনো অধিকার নেই৷
আরেক অ্যাক্টিভিস্ট ও ইরাকের সাবেক সাংসদ আমিনা সৈয়দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের পরিবারেরই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত৷ ‘‘একজন মা হিসেবে আমি অন্য নারীরা কী অনুভব করছেন, তা বুঝতে পারি,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
গোত্রের প্রতিক্রিয়াও তিনি অনুভব করতে পারেন জানিয়ে আমিনা সৈয়দ বলেন, ‘‘কিন্তু তাঁরা তো (ধর্ষণের শিকার নারী) ভুক্তভোগী৷ আমরা যদি তাঁদের জন্য সব দরজা বন্ধ করে দেই, তাহলে তাঁদের দ্বিতীয়বারের মতো শাস্তি দেয়া হবে৷''
‘ইয়াজদা'র উপ-পরিচালক আহমেদ বুর্জুস একটি প্রস্তাব দিয়েছেন৷ তাঁর মতে, সবচেয়ে ভালো হয় যদি এই নারীদের ইরাকের বাইরে অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসন করা যায় এবং তাঁদের সম্মানের জীবন দেয়া যায়৷