স্পেনের একটি আদালত বৃহস্পতিবার পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে এক তরুণীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে নয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ তবে বিক্ষোভকারীদের দাবি, তরুণীটি আসলে গণধর্ষণের শিকার৷
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালের জুলাই মাসে স্পেনের পাম্পলোনায় বাৎসরিক ষাঁড়ের দৌড় উৎসবের সময় আলোচিত এই ঘটনাটি ঘটেছিল৷ মামলার সাক্ষ্য বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ১৮ বছরের ঐ তরুণীকে তাঁর গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল৷ তবে তা না করে সাত মিনিট পর অভিযুক্তরা তরুণীটিকে জোর করে পাশের এক ভবনে নিয়ে গিয়েযৌন নিপীড়ন চালায়৷ সেই সময় তারা ঘটনার ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করে৷ যাওয়ার সময় মেয়েটির ফোনও নিয়ে যায় অভিযুক্তরা৷
এরপর অভিযুক্তরা হোয়াটস অ্যাপের একটি গ্রুপে সেদিনের সেই ঘটনার ভিডিও সগর্বে শেয়ার করেছিল বলেও জানা গেছে৷ অভিযুক্তদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্যও ছিলেন, যাকে পরে বরখাস্ত করা হয়৷ একজন সাবেক সেনাসদস্যও রয়েছে অভিযুক্তদের মাঝে৷ অভিযুক্তরা একে অপরের বন্ধু এবং সবাই সেভিয়ার বাসিন্দা৷
ঘটনার দিন দুই ব্যক্তি মেয়েটিকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় উদ্ধার করেন৷ সেই সময় মেয়েটি কাঁদছিল৷
মামলা চলার সময় অভিযুক্তরা জানায়, যৌনমিলনে মেয়েটির সম্মতি ছিল৷ অভিযুক্তদের আইনজীবী ঘটনার পর মেয়েটির আচরণ, যার মধ্যে এক পার্টিতে তাঁর অংশগ্রহণের ভিডিও-ও আছে, নিয়ে কিছু প্রমাণ আদালতে উপস্থিত করেন৷ এক গোয়েন্দার মাধ্যমে এই প্রমাণ জোগাড় করা হয়েছিল৷ এমন গোয়েন্দা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণাদি আদালত গ্রহণ করতে সম্মত হওয়ায় সেই সময় বিভিন্ন নারীবাদী গোষ্ঠী প্রতিবাদও জানিয়েছিল৷
স্পেনের পামপ্লোনায় ষাঁড় খেদা
উত্তর স্পেনের পামপ্লোনা শহর ‘ষাঁড় খেদার’ বা ‘বুল ফাইটিং’-এর জন্য বিখ্যাত৷ সন্ত ফিরমিনের সম্মানে এই ন’দিনব্যাপী উৎসবে খোলা রাস্তা দিয়ে বুলফাইটিং-এর ষাঁড়দের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় – একটি রক্তাক্ত ও বিতর্কিত প্রথা৷
ছবি: Reuters/E.Alonso
সানফারমিনেস – সন্ত ফিরমিনের উৎসব
উৎসবটা যে কেন সন্ত ফিরমিনের নামে, তা পামপ্লোনার বাসিন্দারাও ঠিক জানেন না৷ সন্ত ফিরমিন এই শহর বা অঞ্চলের রক্ষাকর্তা নন; তাঁর পরবের দিনটিও আসে অক্টোবর মাসে; তবে সন্ত ফিরমিনের জন্ম এখানেই৷ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে পামপ্লোনায় সানফারমিনেস বা সন্ত ফিরমিনের উৎসব চলে আসছে৷
ছবি: Reuters/S.Vera
গলিঘুঁজি দিয়ে দৌড়
মনে রাখা দরকার, এই ষাঁড়গুলোর এক একটির ওজন ৬০০ কিলোগ্রাম৷ পামপ্লোনার গলিঘুঁজি দিয়ে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বুলফাইটিং-এর অ্যারেনার দিকে – যেখানে সন্ধ্যায় বুলফাইটার বনাম ষাঁড়ের লড়াইতে এই প্রাণীগুলির জীবন শেষ হয়৷ দু’লাখ বাসিন্দার শহর পামপ্লোনায় প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষ আসেন ষাঁড় খেদা দেখতে৷
ছবি: Reuters/E.Alonso
দুঃসাহস
দর্শক আর ষাঁড়গুলোর মধ্যে বেড়া দেওয়া আছে, যাতে কেউ আহত না হয় – আবার পামপ্লোনার ষাঁড় খেদার মজাই হলো এই যে, ষাঁড়গুলোই আসলে মানুষকে খেদিয়ে নিয়ে যাবে৷ বিশেষ করে ছেলে-ছোকরারা বেড়া টপকে পথে নামে, ষাঁড়গুলোর নামানো মাথা আর ব্যাঁকানো শিং-এর সামনে কিছুদূর দৌড়ে, তারা যে কতটা সাহসী, সেটা প্রমাণ করে দেবার জন্য৷
ছবি: Reuters/E.Alonso
তিন মিনিটের দৌড়
উৎসবের চলাকালীন প্রত্যেক দিন সকাল আটটায় সন্ত ফিরমিনের নামে প্রার্থনা ও গানের পর ষাঁড়গুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়: ৮২৫ মিটারের পথ যেতে – বা দৌড়তে – ষাঁড়েদের মিনিট তিনেকের বেশি লাগে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/R.Jimenez
মরণ খেলা
প্রতিবারই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে৷ এ বছর ষাঁড় খেদার প্রথম কয়েক দিনেই বহু মানুষ আহত হয়েছেন৷ পামপ্লোনার ষাঁড় খেদায় শেষবার কারো প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটেছে ২০০৯ সালে৷ ১৯১১ সালে যাবৎ সন্ত ফিরমিনের ষাঁড়েদের দৌড়ে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১৫ জন মানুষ৷
ছবি: Reuters/V.West
চোট তো লাগবেই
২০১৭ সালের ‘বুল রান’ বা ষাঁড়ের দৌড়ে শুধুমাত্র প্রথম দিনেই চোট পেয়েছেন পাঁচজন মার্কিনি, তিনজন স্প্যানিশ ও দু’জন ফরাসি পর্যটক৷ সকলকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে৷ দু’জন মার্কিন টুরিস্টকে শিং দিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছে ষাঁড়েরা; বাকিরা পামপ্লোনার প্রাচীন অংশের সংকীর্ণ, পাথর-বসানো গলি দিয়ে ষাঁড়েদের সঙ্গে দৌড়নোর সময় চাপে পড়ে কিংবা পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন৷
ছবি: Reuters/J.Etxaburu
‘জীবজন্তুকে কষ্ট দেওয়াটা খেলা নয়’
পামপ্লোনার ষাঁড় খেদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দানা বাঁধছে বৈকি৷ এ বছর পামপ্লোনার পৌরভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন পশুপ্রেমীরা৷ ষাঁড়েরা দৌড়তে অভ্যস্থ নয়; রাস্তার পাথরের ওপর তাদের খুর পিছলে যায়, ফলে তারা পড়ে গিয়ে চোট পায়: আবার সন্ধ্যায় এই চোট পাওয়া জীবগুলোকে হত্যা করা হয় – একে খেলা বা সংস্কৃতি বলে মানতে রাজি নন তারা৷
ছবি: Reuters/E. Alonso
7 ছবি1 | 7
বৃহস্পতিবার মামলার রায় ঘোষণার সময় পাম্পলোনার আদালত প্রাঙ্গনে অনেকে জড়ো হয়েছিলেন৷ আদালত ঐ অভিযুক্তদের গণধর্ষণের অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার ঘোষণা দিলে রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়৷ এই সময় লোকজন ‘‘এটি যৌন নিপীড়ন নয়, ধর্ষণ'' বলে শ্লোগান স্পেনদিতে থাকে৷
উল্লেখ্য, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেয়া যৌন নিপীড়নের রায়ের অর্থ হচ্ছে, ঐ ঘটনার সঙ্গে ‘সহিংসতা ও ভয় দেখানোর' কোনো বিষয় ছিল না৷
আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার স্পেনের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে৷ দেশটির বিচারমন্ত্রী রাফায়েল কাতালা বলেছেন, ১৯৯৫ সালে প্রণয়ন করা যৌন নিপীড়ন আইনের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করার এখনই সময়৷ উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিচারকদের রায়কে সম্মান করতে হবে, তবে ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে হবে৷
উল্লেখ্য, মেয়েটির পক্ষের আইনজীবীরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২২ বছরের সাজা চেয়েছিলেন৷ কিন্তু আদালত তাঁদের নয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ পাশাপাশি মেয়েটিকে ৫০ হাজার ইউরো দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে৷