1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ধর্ষণে মেয়েদের দায় বেশি’

ব্লগ: হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা২২ নভেম্বর ২০১৪

বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন বলে একটি মার্কিন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা৷

Bangladesh Ausschreitungen Streik
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

বাংলাদেশ পুলিশের এক কর্মকর্তার দাবি করেছেন, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ বখাটেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷ ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ মনে করেন, পুলিশ কর্মকর্তার এই কথায় আবারো ধর্ষণের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনা ফুটে উঠেছে৷ আর ধর্ষকরা নতুন করে উত্‍সাহিত হলে বলার কিছু থাকবে না৷ তাঁর ব্লগ পোস্ট৷

সিলেটে গণধর্ষণের শিকার এক নারীকে নিয়ে একটি সরেজমিন ভিডিও প্রতিবেদন করেছে মার্কিন টিভি চ্যানেল ‘ভাইস নিউজ৷' আর সেই প্রতিবেদনেই দেখানো হয়েছে ধর্ষণ নিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য৷ তিনি দু'দফায় একই ধরনের মন্তব্য করেন৷

সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতক থানার ওই কর্মকর্তা সাংবাদিক তানিয়া রশিদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘অবৈধ মেলামেশা এবং প্রেমের কারণে নারীর ধর্ষণের শিকার হন৷ তারা অধিকাংশ সময়ই সমঝোতার ভিত্তিতেই মিলিত হন৷ পরে জানাজানি হয়ে গেলে সামাজিক কারণে মামলা করেন৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘মেয়েরা যদি আরেকটু পর্দানশিন হন, বেপরোয়াভাবে চলাফেরা না করেন তাহলে ধর্ষণের পরিমান কমে আসবে৷'' ওই পুলিশ কর্মকর্তার মতে, ধর্ষণের ঘটনায় মেয়েদের দায়ই বেশি৷ যারা বেপরোয়া এবং বেপর্দায় চলাফেলা করেন তারাই ধর্ষণের শিকার হন৷ বখাটেরা, অপরাধীরাতো ঘোরাফেরা করবেই৷''

পুলিশ কর্মকর্তার নাম পরিচয় দেয়া হয়নি প্রতিবেদনে৷ তবে তিনি ইউনিফর্মে একবার গড়ির ভিতরে চলন্ত অবস্থায় এবং আরেকবার ছাতক থানায় বসে দু'দফায় একই ধরনের কথা বলেন৷

প্রতিবেদনে দু'জন ধর্ষকেরও সাক্ষাত্‍কার দেখানো হয়েছে মুখ ঢেকে৷ যারা তাদের ধর্ষণের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন৷ তবে এখন অনুতপ্ত৷ আর ধর্ষিতাকে দেখানো হয়েছে স্পষ্টভাবেই৷ তার বাড়ি থেকে শুরু করে তাঁর সাক্ষাত্‍কার সবকিছুই৷ আর ২০ মিনিটের এই প্রতিবেদনটি শুরুই হয়েছে ধর্ষিতা নারী এবং তার বক্তব্য দেখিয়ে৷ যেখানে ধর্ষিতা তাঁকে ধর্ষণের বর্ণনা দিয়েছে৷

প্রথমেই আসা যাক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে৷ তিনি ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করে তার মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে কী ধরনের নির্মমতা এবং হয়রানির শিকার হন৷ প্রতি পদে পদে তাকে নতুন করে ধর্ষণ করা হয়৷ পুলিশ তদন্তের শুরুতেই ধর্ষিতাকে দায়ী করতে থাকে৷ আর ধর্ষক তখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়৷ এরপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষিতা৷ তার ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সবখানেই হয়রানি৷ এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও ধর্ষিতাকে দায়ী করা হয়৷ আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলে তো কথাই নেই৷ সমাজপতি বা ধর্মীয় নেতারা নারীকে দায়ী করে সালিশের মাধ্যমে ফয়সালা করেন থানা পর্যন্ত যেতে দেন না৷ আর কেউ কেউ সামাজিক চাপ এবং হয়রানির ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েও চুপ থাকেন৷

চুপ না থেকে উপায় কী? পুলিশেরই যদি এই মনোভাব হয় তাহলে আর থানায় গিয়ে লাভ কী৷ বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে৷ এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ কিন্তু সেই আইন যারা কার্যকর করবেন, যারা তদন্ত করবেন, বিচারের জন্য মামলাটিকে প্রস্তুত করবেন তারাই যদি ধর্ষকদের পক্ষ নেন তাহলে কীভাবে ধর্ষিতা বিচার পাবেন৷ দিনাজপুরের ইয়াসমীনের কথা এখনো আমাদের মনে আছে৷ সেখানে রক্ষক পুলিশই ভক্ষক হয়েছিল৷ ধর্ষণের পর তাকে পতিতা বানানো হয়েছিল৷ ইয়াসমীন জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে, ধর্ষকরা কত শক্তিশালী৷

বাংলাদেশে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে এবং তার সংখ্যাও কম না৷ জাতীয় মহিলা পরিষদের জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছ'মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষনের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ এ সময়কালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে৷ এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরও ৫১ জন৷

আর জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়৷ অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে৷

এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে৷ ভাইস নিউজকে সাক্ষাৎকার দেয়া সিলেটের পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, ‘‘এর জন্য নারী এবং নারীর বেপরোয়া ও বেপর্দা চলাফেরা দায়ী৷'' তবে আমি মনে করি এরজন্য পুলিশের এই মানসিকতাই প্রধানত দায়ী৷ এবং এই মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে ধর্ষকরা আরো উত্‍সাহিত হবে৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপনছবি: Harun Ur Rashid Swapan

পুলিশের মনে রাখা, উচিত তাদের কাজ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা, তাদের অপরাধে উত্‍সাহিত করা নয়৷ আর স্বাধীনভাবে চলাফেলা করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার৷ সেটা তাদের নিশ্চিত করা আইনি দায়িত্ব৷ এই দায়িত্ব পালনের জন্যই জনগণের পয়সায় তাদের বেতন দেয়া হয়৷

এবার আসি ‘ভাইস নিউজ' এর প্রতিবেদনের আরো কিছু দিক নিয়ে৷ প্রতিবেদক তানিয়া রশীদ কেন ধর্ষিতা নারীর সরাসরি ছবি দেখালেন আর কেনো পরিচয় প্রকাশ করলেন তা আমার কাছে পরিস্কার নয়৷ আর প্রতিবেদনটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা৷

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষিতার ছবি বা তাঁর নাম ঠিকানা প্রকাশ করা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে ধর্ষিতা যদি স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে চান বা প্রতিবাদ জানাতে চান তাহলে আলাদা কথা৷ কিন্তু ধর্ষিতাকে অবশ্যই জানাতে হবে তাঁর ছবি প্রকাশ হলে তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে কী না তা৷ আর আইনে ছবি বা নাম পরিচয় কেনো প্রকাশে বাধা আছে তাও বলতে হবে৷ ভাইস নিউজের প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে নারী স্বেচ্ছায় তাঁর ছবি ও নাম পরিচয় প্রকাশ করেছেন৷

তারপরও এই প্রতিবেদনটি আরো একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে ধর্ষিতারা কতটা অসহায়৷ আর ধর্ষকরা কতটা নিরাপদ৷ এখানে পুলিশ কীভাবে ধর্ষণকে উত্‍সাহিত করে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ