বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে রাষ্ট্রের ব্যর্থতায়৷ অপরাধের সামাজিক প্রতিরোধে ঘাটতির দায় সমাজের৷ আর ব্যক্তির দোষ অনেকটাই পরিবারের৷ ধর্ষণের দায়ও নিতে হবে তাই এ তিন পক্ষকেই৷
বিজ্ঞাপন
বিশ শতকের একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে ছিল অনেক ধর্ষকও৷ তাদের শিকার হয় অন্তত দুই লাখ ৩০ হাজার নারী৷ নিপীড়িত এই নারীদের সম্মান জানাতে গিয়ে এদেশের বক্তার দল প্রায়ই ‘সম্ভ্রমহানি' শব্দটি প্রয়োগ করে থাকেন৷ এখানে ‘সম্ভ্রমহানি'- আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ধর্ষণের লজ্জার ভাগ নিতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীকেই৷ অথচ অন্য যেকোনো অপরাধের বেলায় দোষ বলুন, লজ্জা বলুন- সবই অপরাধীর৷ এর জন্যেই ধর্ষণের ঘটনায় শুধু ভূক্তভোগীর নাম-ছবি-পরিচয় প্রকাশ থেকে দূরে থাকে গণমাধ্যম৷ যেদিন এমন এক সমাজ হবে, যেখানে ধর্ষণ একটি অপরাধ, তার দায় শুধুই অপরাধীর সেদিন সামাজিক লজ্জার হাত থেকে মুক্তি মিলবে অনাচারের শিকার নারীদের৷ ‘সম্ভ্রমহানি' নামের শব্দের অপ্রয়োগ বন্ধে তাই এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সমাজকে৷ এই কাজে নেতৃত্ব দিতে পারে দেশের সুশীল সমাজ৷ কিন্তু এই কালে এসে আপাতত নেই কোনো ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; যিনি নিজের পুত্রকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিবেন- এমন উপমা তৈরির পর বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে সাফল্য নিয়ে আসবেন৷ এমন সমাজসংস্কারক না থাকার দায় কি স্বীকার করবে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নাগরিক সমাজ?
দুই.
যাপিত জীবনে প্রতিযোগিতা বাড়ছে৷ বাড়ছে কর্মব্যস্ততা৷ সন্তানকে সময় দেয়ার মতো সময় আজকাল অনেকের হাতেই নেই৷ তাই সন্তানকে ‘কোয়ালিট টাইম' বা ‘গুণগত সময়' দিন- এমন বক্তব্য বেশি বেশি দিতে হচ্ছে মানসিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের৷ তবু এ নিয়ে মনযোগ কম অনেক অভিভাবকেরই৷ দায় এড়াতে শৈশব বা কৈশোরে সন্তানের হাতে তারা তুলে দিচ্ছেন ল্যাপটপ, মোবাইলসহ প্রযুক্তির নানা উপকরণ৷ যা হয়তো তার পাওয়ার কথা ছিলো প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক হওয়ার পরে৷
ধর্ষণ: কিছু ঘটনা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয়৷ কোনোটি আলোচিত হয়, কোনোটি আড়ালেই থেকে যায়৷ এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই৷ শিক্ষা, ধর্ম, আইন কোনো কিছুই মানছেন না ধর্ষকরা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ এক মাস আগে ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়৷ তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি৷ গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু৷ খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪৷ এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন৷ নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন৷ অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন৷ ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে৷ যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে৷ একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে৷ গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে৷ তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি৷ গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ৷ বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই৷ তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন৷ ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল৷ নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
অন্যদিকে সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কী করে- এসব খবরই রাখে না অনেক মাতাপিতা৷ কখন, কোথায়, কী করতে হবে, কোন কোন বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে- এসব বিষয়ে পারিবারিক শিক্ষারও বালাই নেই অনেক পরিবারে৷ তাই আচমকাই কিশোর অপরাধীর খাতায় নাম চলে যায় কারো কারো সন্তানের৷ কেউবা ধর্ষক হিসেবে হয় কারাবন্দী৷ তখন অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয় অপরাধীর অভিভাবকদের দিকেও৷ সন্তানকে মানুষ করতে না পারার অভিযোগ, অস্বীকার করার কোনো পথ থাকে না সেই শেষবেলায়৷
তিন.
কিশোর-যুবারা কেমন চুল রাখবে, কী পোশাক পরবে, কখন আড্ডা দিবে, কখন খেলবে- এগুলো দেখভাল করার কথা পরিবারের৷ হালের বাংলাদেশে কোনো কোনো এলাকায় এসব ঠিক করে দিচ্ছে পুলিশ৷ কিন্তু কিশোর অপরাধ বিষয়ে সম্প্রতি সতর্কবাণী দিতে গিয়ে পুলিশ-প্রধান আইজিপি বেনজীর আহমেদ যে ভাষ্য দিয়েছেন, তার মানে দাঁড়ায়- পিতামাতারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তার দায়দায়িত্বও তাদের নিতে হবে৷ ‘দায়দায়িত্ব নিতে না পারেন, তাহলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন কেন?'- এই প্রশ্ন বাংলাদেশের আইজিপির৷
অপরাধী সে যে বয়সেরই হোক, তাকে পাকড়াও করার দায়িত্ব পুলিশের৷ বিচার করবেন আদালত৷ তাই শুধুই মাতাপিতার দোষ খুঁজে বেড়ালেই কর্তব্যকর্ম শেষ হয়ে যায় না৷ কেননা অপরাধ হয়ে গেলে দায়িত্ব চলে আসে নিরাপত্তাপ্রশাসন ও বিচারালয়ের হাতে৷ তাই ধর্ষকের মতো অপরাধী ধরার বিষয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে পুলিশকে৷ করতে হবে যথাযথ তদন্ত৷ আর অপরাধ চূড়ান্ত করবেন আদালত৷ ধর্ষকের সাজা কেমন হবে- সেটার এখতিয়ারও তাদের৷ কিন্তু অপরাধীকে যদি ধরাই না যায়; কিংবা তদন্ত ও বিচারকাজে যদি বছরের পর বছর চলে যায়, তবে তো ভুক্তভোগীর ভোগান্তির মাত্রা লম্বাই হতে থাকে৷ পুলিশ ও আদালতের বেলায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে রাষ্ট্রকে৷ কারণ বর্তমান ব্যবস্থায় সবকিছু সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারে৷ ধর্ষণের দায়ও তাই কোনোক্রমেই এড়াতে পারে না সে৷ কারণ ধর্ষকও তারই নাগরিক৷ তাকে সুনাগরিক করতে না পারার ব্যর্থতা পরিবার ও সমাজের শুধু নয়, রাষ্ট্রেরও বটে৷