ধর্ষণ এবং অজাচারের ক্ষেত্রেও গর্ভপাত নিষিদ্ধের উদ্যোগ!
১৫ মে ২০১৯
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা রাজ্য প্রায় সব ধরনের গর্ভপাত নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছে৷ তবে এই আইন প্রণয়ন নিয়ে আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, যা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া গর্ভপাত বিষয়ক এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবার ঐকবদ্ধ হয়েছে দেশটির ১৪টি রাজ্য৷ ‘রো ভার্সেস ওয়েড' নামে পরিচিত সেই সিদ্ধান্তে মার্কিন সংবিধান অনুসারে গর্ভপাতের বিষয়ে একজন নারীকে কার্যত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল৷
মার্কিন রাজ্য আলাবামার রিপাবলিকান-সংখ্যাগরিষ্ঠ সেনেট মঙ্গলবার প্রায় সব ধরনের গর্ভপাত বাতিলের একটি বিল পাস করেছে৷ এমনকি ধর্ষণ এবং অজাচারেরক্ষেত্রেও গর্ভপাতের সুযোগ বাতিল করা হয়েছে এই রিটে৷ এই বিল যদি রিপাবলিকান গভর্নর কে আইভি অনুমোদন করেন, তাহলে তা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত সংক্রান্ত সবচেয়ে কঠোর আইন৷ গভর্নর অবশ্য বিলটি অনুমোদন করবেন কিনা সেই বিষয়ে এখনো কিছু জানাননি৷ অনুমোদন করার ছয় মাসের মধ্যে তা প্রয়োগ করা যাবে৷
গর্ভপাত সংক্রান্ত এই বিল নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়েরও সম্ভাবনা রয়েছে৷ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা এবং গর্ভপাতবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টরা আশা করছেন যে, নতুন এই আইন ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া গর্ভপাত বিষয়ক ঐতিহাসিক ‘রো ভার্সেস ওয়েড' সিদ্ধান্তকে বাতিলের পথ তৈরি করবে৷
আয়ারল্যান্ডে সবিতার জয়
গর্ভপাত নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত আইরিশরা তাঁদের ভোট দিয়েছেন৷ সেই ভোটের ফলাফল গর্ভপাতকে আয়ারল্যান্ডে আইনসিদ্ধ করতে চলেছে৷ নতুন এ আইনের নাম সবিতা হলপ্পনবার নামের প্রয়াত এক ভারতীয় নারীর নামেই করার দাবি উঠেছে৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
গণআন্দোলন
২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাতবিরোধী আইনের ফাঁদে পড়ে যে নারীর মৃত্যু হয়েছিল, যাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল গণআন্দোলন; তাঁর নাম সবিতা হলপ্পনবার৷ দন্তচিকিৎসক সবিতা মিসক্যারেজের পর সংক্রমণে মারা যান৷ তাঁর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল আয়ারল্যান্ডের মানুষকে৷ ২০১৮-তে গর্ভপাতবিরোধী আইন শিথিল করার দাবিতে পথে নেমেছিলেন তাঁরা৷ গণভোটে তাঁদের জয় হয়েছে৷
ছবি: Gavan Reilly
যে কারণে ভোট
রক্ষণশীল আয়ারল্যান্ডে মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রুণও জীবিত মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ সে হিসেবে একজন মানুষের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তেমনি একটি ভ্রুণও একই অধিকার রাখে৷ তাই ১৯৮৩ সাল থেকে দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ থাকায় এতদিন নারীরা অন্যদেশে পাড়ি জমাতেন গর্ভপাত করতে৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার গর্ভপাতের পক্ষে ছিলেন৷ তিনি শুক্রবারের ভোটকে 'ওয়ান্স ইন আ জেনারেশন চান্স' বলেছেন৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
পথদিশারী সবিতা
আইরিশ রক্ষণশীল সমাজের পক্ষে এই ভোটে পৌঁছানোর রাস্তাটা মোটেই মসৃণ ছিল না৷ এর আগে ১৯৮৩ সালেও একবার গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু তখনও সমাজে ক্যাথলিক নেতাদের যথেষ্ট রমরমা৷ ফলে গণভোটে চুড়ান্ত হার হয়েছিল গর্ভপাতকামীদের৷ কিন্তু এরপর এই আন্দোলনকে আবার পথ দেখান সবিতা৷
ছবি: picture-alliance/empics/N. Carson
ভোটের ফল
মোট সাড়ে ২১ লাখ ভোট পড়েছে, যা আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের যে কোনো গণভোটে সর্বোচ্চ৷ গর্ভপাতের পক্ষে পড়েছে ১৪ লাখ ৩০ হাজার, বা ৬৬ দশমিক ৪ ভাগ৷ অর্থাৎ রোমান ক্যাথলিকপ্রধান দেশটিতেও প্রতি তিন জনের দু'জন চান যে, মায়ের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে গর্ভপাতের সুযোগ থাকুক৷ রায় ঘোষণার দিন গর্ভপাতের স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ‘সবিতা’ ‘সবিতা’ বলে স্লোগান দিতে দেখা যায়৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
সবিতাও আইনি সমস্যার শিকার
মিসক্যারিজ, অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের সময় সবিতার প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের পক্ষ থেকে গর্ভপাতের আবেদন করা হয়েছিল৷ আইরিশ চিকিৎসকরা তাতে রাজি হননি৷ এর মূলে ছিল আইনি সমস্যা৷ কয়েক দিন দুর্বিসহ যন্ত্রণা ভোগ করে শেষ পর্যন্ত রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় মারা যান ৩১ বছর বয়সি সবিতা৷ তবে তাঁর মৃত্যু বৃথা যায়নি৷ ৬ বছর পরে আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত আইন সংস্কার হচ্ছে৷ আর তাই নতুন এ আইন সবিতার নামে উৎসর্গ করার দাবি উঠেছে৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
আইনের নাম ‘সবিতা ল’ ?
কিন্তু এখনো আইন পাস হয়নি৷ আইরিশ সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে বিল পাস হওয়ার পরই বৈধ হবে গর্ভপাত৷ আইরিশ সংসদেই সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করে যে আইন করা হয়েছিল, তা বদলে নতুন আইন তৈরি হবে৷ দ্রুত সেই আইনি স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে সবিতার নামেই নতুন আইনের নামকরণ করার দাবি জানিয়েছেন তাঁর বাবা আন্দানাপ্পা ইয়ালগি৷
ছবি: Getty Images/C. McQuillan
জয়ের নেপথ্যে
ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে গর্ভপাত নিষিদ্ধ৷ সবিতার মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়৷ হাসপাতালে ভর্তির প্রথম তিন দিনের মধ্যে গর্ভপাত করা হলে হয়ত সবিতা বেঁচে যেতেন বলে জানিয়েছিলেন দেশটির এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷ ঐতিহ্যগতভাবে রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশটিতে আজ মানুষ রীতিনীতির বদলে সামাজিক সমস্যার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন৷ এজন্য অনেকেই এই আন্দোলনের পথিকৃৎ সবিতাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
স্মৃতিতে উৎসর্গ
সবিতার মৃত্যুর পর তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল আয়ারল্যান্ডে৷ সবিতাই ছিলেন সেই আন্দোলনের মুখ৷ তাঁর ছবি দিয়ে বের হয় পোস্টার৷ গর্ভপাতপন্থিরা সবিতার স্মরণে মোমবাতি মিছিল করেন৷ সবিতার মৃত্যু যে আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল তার রাশ হাতে তুলে নেন আইরিশ মহিলা সমাজ৷ পক্ষে-বিপক্ষে যা-ই যুক্তি দেওয়া হোক সবটাই ছিল মহিলাদের তরফ থেকে৷ তাই ভোটে জয় পেয়ে ‘হ্যাঁ’পন্থি মহিলারা সবিতার ছবির সামনে ফুল ও চিঠি রেখেছেন৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
সবিতাকে কেউ ভোলেনি
গণভোটে রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ আয়ারল্যান্ডের জন্য একটা ঐতিহাসিক দিন৷ এখানে নিঃশব্দে বিপ্লব হয়েছে৷ গোপনীয়তা থেকে পর্দা উঠে গেল৷’’ এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ সবিতাকে কেউ ভোলেনি৷ অনেক মানুষকে সবিতার নামে তৈরি স্মারকে ফুল ও হাতে লেখা চিঠি দিতে দেখা গেছে৷ সেখানে একটি চিঠিতে লেখা ছিল, ‘‘অনেক দেরি করে ফেলার জন্য আমরা দুঃখিত৷ কিন্তু আমরা আজ এখানে পৌঁছতে পেরেছি, আমরা তোমাকে ভুলে যাইনি৷’’
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
শান্তির পথযাত্রী
প্রধানমন্ত্রী ভারাদকর গণভোটের ফলাফলের পরে বলেন, ‘‘এই দিনে আয়ারল্যান্ড শেষ কালোছায়াটি অতিক্রম করে আলোতে এলো৷ একদিনেই আমরা একটি যুগ পেরোলাম৷ আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে শামিল হলাম৷'' সবিতা এই যুগে আর নেই৷ তবুও আয়ারল্যান্ডে আজ তিনি জয়ী৷ ঐতিহাসিক রায়ে খুশি জনগণ সবিতার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন৷
ছবি: Reuters/C. Kilcoyne
10 ছবি1 | 10
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুপ্রিমকোর্টের দুই বিচারপতির নাম ঘোষণা করার বিষয়টি গর্ভপাতবিরোধীদের আশাবাদী করে তুলেছে৷ বিলটির সমর্থক রিপাবলিকান স্টেট সেনেটর ক্লাইড চামব্লিস স্বীকার করেছেন যে, এসব করা হয়েছে যাতে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ‘রো ভার্সেস ওয়েড'-কে চ্যালেঞ্জ করা যায়৷
প্রসঙ্গত, আলাবামার সেনেটে পাস হওয়া গর্ভপাতবিরোধী বিলটিতে গর্ভপাত ঘটালে ৯৯ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে৷ তবে যে নারীর গর্ভপাত করা হবে, তাঁর ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে না৷ বিলটিতে শুধুমাত্র গর্ভধারণের কারণে কোনো নারী যদি স্বাস্থ্যগতভাবে চরম ঝুঁকিতে পরেন, সেক্ষেত্রে গর্ভপাত করার সুযোগ রাখা হয়েছে৷
উল্লেখ্য, গর্ভপাতের বিপক্ষে যে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না৷ আর ডেমোক্র্যাটরা এই বিলের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন বিল করা হয়েছে, যেখানে নারীর স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷