যৌন শিক্ষার অভাব কি ধর্ষণের পেছনে কোন ভূমিকা রাখে? ধর্ষণ কমানোর উপায় কী? এসব প্রশ্ন মাঝেমাঝেই উঁকি দেয় মনে৷ এক্ষেত্রে জার্মানির কিছু উদ্যোগ এবং নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছি৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির কথাই আগে বলি৷ ২০১৫ সালে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় ইউরোপের দেশটি৷ তখন শুধু সিরিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকেও অনেক শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করে৷ সংখ্যাটি অন্তত দশ লাখ৷
এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী আসার পর জার্মানিতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার নানা খবর শোনা গেছে৷ আর সেসব ধর্ষণের পেছনে কখনো কখনো অভিবাসীদের জড়িত থাকার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আসতে থাকে৷ অভিবাসীদের সম্পর্কে অনেক জার্মানের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির একটি কারণও এসব ধর্ষণের অভিযোগ৷
বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্রীদের যৌনশিক্ষা
02:44
জার্মানি তখন ধর্ষণের ঘটনা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল৷ অভিবাসীদের যৌন শিক্ষা দিতে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছিল জার্মান সরকারের অর্থায়নে৷ সাইটটির ভাষা হিসেবে জার্মান, ইংরেজির পাশাপাশি আরবি, তুর্কিসহ এমন কিছু ভাষা রাখা হয়েছিল, যেসব ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে প্রচুর অভিবাসী জার্মানিতে আসে৷
যৌন শিক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটে নারী-পুরুষের শরীর, যৌনতা, পরিবার, গর্ভধারণ বিষয়ক নানা তথ্য ছবিসহ দেয়ার পাশাপাশি পরষ্পরের মধ্যে সম্পর্ক, সম্মতি, আইনি অধিকারের বিষয়াদিও ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ বলা যেতে পারে একজন মানুষের যৌন শিক্ষা বিষয়ক যেসব তথ্য জানা দরকার, সবই সেখানে রয়েছে৷ যৌন শিক্ষা জার্মানির স্কুলে অনেক আগে থেকেই দেয়া হয়৷ এই ওয়েবসাইট সেখানে যুক্ত হয়েছে অভিবাসীদের জন্য যাতে তারাও বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায়৷
অথচ, আমাদের দেশের পরিস্থিতি কিন্তু এখনো অনেকটাই ভিন্ন৷ অভিবাসী দূরে থাক, দেশটির সাধারণ মানুষেরই যৌন শিক্ষা পাওয়ার কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই৷ বরং এটা এমন এক নিষিদ্ধ বিষয় যে, এই নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষক কাউকে প্রশ্ন করাই যেন এক অপরাধ৷ মনে আছে, উচ্চ মাধ্যমিকের জীববিজ্ঞান বইতে মানুষের জননাঙ্গ সম্পর্কে একটি অধ্যায় ছিল৷ সেখান থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো বটে, তবে সেই অধ্যায় শিক্ষকরা ক্লাসে বা প্রাইভেট টিউশনিতে পড়াতেন না৷ বলতেন নিজে নিজে শিখে নিতে৷
গত শতকের শেষের দিকে বা বর্তমান শতাব্দির শুরুর দশকেও আমাদের সমাজে কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতীদের যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান পাওয়ার মূল উৎস আসলে ছিল ‘ব্লুফিল্ম’৷ অবাস্তব, অস্বাভাবিক সেসব ফিল্ম দেখে যৌনতা বিষয়ক যে জ্ঞান তাদের হয়, তাতে আর যা-ই হোক ধর্ষণ, সম্মতি, স্বাভাবিক যৌন জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন৷ বরং মনে হতে পারে, যৌন সঙ্গম হচ্ছে নারীর উপর কর্তৃত্ব খাটাতে পুরুষের এক অবলম্বন৷ আর এক্ষেত্রে জোর খাটানোটা যেন পুরুষত্বের বহিঃপ্রকাশ৷
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশে যৌনশিক্ষা চালুর নানা কথা শোনা যাচ্ছে৷ তবে, সেটার পরিধি যে খুব সীমিত সেটা বোঝাই যায়৷ বরং নিকট অতীতে দেখেছি সম্মতি বিষয়ক এক ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে একটি জনপ্রিয় শিক্ষা বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম থেকে৷ সেটা না করলে প্ল্যাটফর্মটির মালিককে হত্যার হুমকি দিয়েছিল ধর্মান্ধরা৷
যৌন শিক্ষা ধর্ষণ প্রতিরোধে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানারকম মন্তব্য রয়েছে৷ আমি মনে করি, ধর্ষণরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ আর নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি যৌন শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে৷ মানুষের যৌনাঙ্গ, যৌনতা, সম্মতি, সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের প্রকৃত জ্ঞান জরুরি৷ আর এসব জানলে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এমনিতেই ঘুঁচে যাবে, কমবে নারী-পুরুষের মধ্যকার মানসিক দূরত্ব৷
২০১৮ সালের জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...
বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা
পাঠ্যপুস্তকে যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার৷ কিন্তু যৌন শিক্ষা পড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ শিক্ষকরা এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷ কী বলছে আজকের তরুণ সমাজ?
ছবি: DW/K. Andrade
ফারজানা খানম
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী ফারজানা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হচ্ছে যা থেকে যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়৷ এ শিক্ষা প্রত্যেকের জীবনে প্রয়োজন৷ বাচ্চাদের পরিবার এবং শিক্ষকরা এটা শিখাতে পারেন৷ এছাড়া যৌনতা সম্পর্কে তাদের জানার উৎস হতে পারে পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব৷ তাছাড়া ইন্টারনেট থেকেও যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়, জানান ফারজানা৷
ছবি: DW
নাফিসা হক অর্পা
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্রী নাফিসা হক অর্পা৷ নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা৷ নাফিসার কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না৷ তখন বন্ধু, সহপাঠী, আত্মীয়স্বজনরাই ছিলেন মূল ভরসা৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটাকে ট্যাবু হিসেবে না দেখে একে শিক্ষার অংশ করা উচিত৷ এতে করে যৌন বিষয়ক অপরাধ কমবে৷
ছবি: DW
জান্নাতুল ফেরদৌস কনক
নাফিসার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস কনক, তবে তিনি পড়ছেন পঞ্চম সেমিস্টারে৷ তাঁর মতে, যৌনতা হচ্ছে বয়সের পরিবর্তনে শারীরিক এক ধরণের চাহিদা৷ আগে এ নিয়ে সীমাবধ্যতা থাকলেও, এখন ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ের যৌন সম্পর্কও বেশ জনপ্রিয়৷ ‘‘বন্ধুদের আড্ডায় এটাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়’’, জানান কনক৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার দরকার না থাকলেও এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি৷
ছবি: DW
ইমরান খান
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ইমরান খান৷ তিনি যৌন শিক্ষা বলতে যৌনতা সম্পর্কে সব ধরণের ধারণাকে বোঝেন৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা সবার জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়৷ আর এ কথাটা শিশুদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য৷ তবে ইমরানের কথায়, ‘‘সঠিক যৌন শিক্ষা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, পরিবার থেকেই গড়ে উঠতে পারে৷’’
ছবি: DW
কেডিএস সাকিব
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফিসা আর কনকের মতো মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছেন সাকিব, পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান৷ তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই বন্ধুদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনেছেন তিনি৷ সাকিবের মতে, পর্যাপ্ত যৌন শিক্ষা অবশ্যই দরকার৷ যৌনতা সম্পর্কে তাঁর জানার মূল উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং এ সম্বন্ধে লিখা বিভিন্ন বই৷
ছবি: DW
মাহবুব টিপু
নাফিসা, কনক, সাকিব আর ফারজানার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন মাহবুব টিপু৷ অবশ্য তিনি এখনও দ্বিতীয় সেমিস্টারে৷ যৌন শিক্ষা তাঁর কাছে যৌনতা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে৷ এ বিষয়ে জানার সবচেয়ে বড় জায়গা বন্ধু-বান্ধব৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো সবারই কম-বেশি জানা থাকে৷ তারপরও এ বিষয়ে শেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম বিভিন্ন ওয়েবসাইট৷
ছবি: DW
সামিয়া রহমান
সামিয়া রহমানও মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ যৌন শিক্ষা বলতে তিনি বোঝেন নারী ও পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞান৷ তাঁর কথায়, ‘‘যৌন শিক্ষা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ একটি বিষয়ের মতো৷ তাই এ বিষয়ে আমি শিক্ষা পায়নি৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা খুবই জরুরি৷ এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ভুল পথে চলে যায়৷ তাই বাবা-মায়েরও এ বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা উচিত৷
ছবি: DW
নাফিউল হক শাফিন
টিপু আর সামিয়ার মতো অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মাস কমিউনিকেশন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাফিউল৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়৷ তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শেখেননি৷ তবে এই শিক্ষাটা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার জন্য বড় কেউ কিংবা সহপাঠীরাই বড় মাধ্যম৷
ছবি: DW
মালিহা রহমান
মালিহা রহমানও ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা৷ অবশ্য তাঁর কথায়, যৌন শিক্ষা একটা স্বাভাবিক বিষয় যেটা মানুষ থেকে শুরু করে সব প্রাণীই প্রাকৃতিকভাবে জানে৷ তাঁর মতে, এ বিষয়ে আগে থেকে জানার কিছু নেই, নেই ভালো কোনো দিক৷ যখন এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন হবে তখন এমনিতেই তা জানা যাবে৷