ভারতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ‘নগ্ন' করে তুলছে দেশের ভাবমূর্তিকে৷ একদিকে ‘দুর্বল' আইন অন্যদিকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষিতা নারীর মানসিক অবস্থাকে আরও ভেঙ্গে দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ভারতে ২১ বছর বয়সি এক কলেজ ছাত্রীকে দ্বিতীয়বারের মতো ধর্ষণ করেছে পুরোনো অপরাধীরা৷ তিন বছর আগে তাদের দ্বারাই গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক দলিত নারী৷ অথচ এই তিন বছরে ঐ পাঁচ অপরাধীর কেউ নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করেনি, একটু অনুশোচনাও হয়নি তাদের৷ বরং জামিন পাওয়ার পর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তারা৷
আর তিন বছর পর সেই পাঁচ জনই আবার ‘বদলা' নিয়েছে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে৷ মেয়েটির ‘অপরাধ' সে আদালতে সেই উচ্চবর্ণের পুরুষদের বিচার দাবি করেছিল৷ প্রথমে তারা মেয়েটিকে কলেজের সামনে থেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে৷ রাজি না হওয়ায় আবারও গণধর্ষণ৷
এ কেবল একটি ঘটনা মাত্র৷ ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে ঘটছে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনা৷ রাজধানী দিল্লিসহ অন্যান্য শহরেও এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে৷
ভারতের ধর্ষণবিরোধী আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, তাই বিচারকদের নিজস্ব বিচারবোধের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ তাই অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের ‘ন্যায়বিচার' থেকে বঞ্চিতও হতে হয়৷ অর্থাৎ বিচারক যদি মনে করেন ধর্ষকের অপরাধ ততটা গুরুতর নয়, যতটা ধর্ষিতা বলছে, সেক্ষেত্রে অপরাধীর লঘু শাস্তি হয়৷ কিংবা ধর্ষিতা কুমারী না বিবাহিতা, মহিলার চরিত্র ত্রুটিমুক্ত কিনা এসবও বিচার্য হয়৷ তাই অপরাধী অনেক সময় বেকসুর খালাসও পেয়ে যায়৷
দ্বিতীয়ত, ভারতের আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল৷ বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ দুর্বল হয়ে পড়ে৷ দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণকাণ্ডের পর এই সংক্রান্ত আইন কঠোর করতে ভার্মা কমিশনের সুপারিশ মেনে তা সংশোধন করা হয়৷ এখন দোষী সাব্যস্ত হলে আসামির হয় যাবজ্জীবন জেল বা বিরল ঘটনার ক্ষেত্রে ফাঁসিও হতে পারে৷
এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিকৃত মানসিকতার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতা আর দেশের বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি তো রয়েছেই৷ ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ প্রথমে চেষ্টা করে, অভিযোগ না নিয়ে লোকলজ্জার ভয় দেখিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে টাকা-পয়সা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে৷ অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েও ‘ফয়সালা' করা হয়৷
অন্যদিকে, ভারতীয় সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ' বলা যায় না, কারণ, তাহলে বিবাহ নামক সম্পর্কটাই নাকি নষ্ট হয়ে যাবে৷ চলতি বছরেই ভারতের কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মানেকা গান্ধী সংসদে এ কথা বলেছিলেন৷ বৈবাহিক ধর্ষণকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে আদালতে প্রমাণ করাও সহজ নয়৷ এ সম্পর্কে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট আইনি সংস্থানও নেই৷ দৈহিক নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে তা প্রমাণ করা গেলেও, স্ত্রীর সম্মতি ছিল কিনা সেটা আদালতে প্রমাণ করা বেশ কঠিন৷
আর কোনো মেয়ে আদালতে বিচারের জন্য গেলে মেয়েটিকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হয় সে কীভাবে ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে৷ এভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিবার ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় মেয়েটি৷ অন্যদিকে, সমাজ মেয়েটিকেই দোষী বলে মনে করে৷ বাবা- মা কে শুনতে হয় মেয়েটির পোশাক, আচার-আচরণ বা কোন একটি কারণে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ উদাহরণ দেয়া হয় অন্য মেয়েদের, বলা হয় ‘তারাতো ধর্ষণের শিকার হয়নি'৷
পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে মেয়েদের খুন করা হলেও তার চরিত্র নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া চলে৷ আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বাংলাদেশের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কথা৷ নিশ্চয়ই মনে আছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার কথা৷ অথবা কলেজ ছাত্রী তনু হত্যার কথা৷
রুনি, মিতু বা তনুকে কে হত্যা করেছে সেটা তদন্তের চেয়ে মূখ্য হয়ে উঠেছিল কাদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল, তাদের চরিত্রের ময়নাতদন্ত করে ছেড়েছে গণমাধ্যম৷ অর্থাৎ গণমাধ্যমও যে এই সমাজের ছায়া তা বলতেই হয়৷ তাই শক্তিশালী আইনের যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি বিকল্প নেই এই সমাজ পরিবর্তনেরও৷
আর এমনটা না হলে ভারত-বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা যৌন নিগ্রহের শিকার হতেই থাকবে৷ অপরাধীরা বিনা বিচারে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াবে৷ অন্যদিকে প্রতিটি নারীর উচিত নিজেকে ছোটবেলা থেকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা৷ কোনো পুরুষের বাজে স্পর্শে সংকুচিত না হয়ে প্রতিবাদ করা৷ সেইসাথে সামাজিক গণমাধ্যমে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রতিরোধও গড়তে শেখা৷ সমাজে পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন পরিবারের ছেলেটি বা পুরুষটি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে৷ তাই ছোট থেকেই সন্তানকে সেইভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে একজন নারীকে অসম্মান করার আগেই তার বিবেক জেগে ওঠে৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷