বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে৷ অথচ ধর্ষণের শতকরা মাত্র তিন ভাগ মামলার অপরাধীরা শাস্তি পায়৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এখন অনেকটাই অকার্যকর৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে মানবাধিবার সংস্থাগুলো থেকে ধর্ষণের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেগুলো করা হয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে৷ তাই মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, ‘‘থানায় মামলা হলেও সব ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসেনা৷ আবার অনেক ঘটনায় মামলাই হয় না৷ আমাদের কাছেও অনেকে আইনি সহায়তার জন্য আসেন৷ ফলে সব মিলিয়ে বাস্তবে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণের কম হবে না৷’’
আসকের হিসেবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন বাংলাদেশে কমপক্ষে চার জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ নিনা গোস্বামী বলেন, ‘‘মাত্র শতকরা তিন ভাগ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পান৷’’
আসকের হিসেব মতে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ৫৯টি৷ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে৷ ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন৷ আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন৷ ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে ৷ ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন৷ হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷
ধর্ষক কেন, কী ভেবে ধর্ষণ করে?
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সময় কীভাবে কাজ করে ধর্ষকের মন ও মস্তিষ্ক? এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কী বলেছেন তা বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/China Photos
সব সময় যৌনসুখ মুখ্য নয়
সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবির মতে, ‘‘ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়৷’’ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়৷ অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসাবে৷ এছাড়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা বুঝতে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images
কে ধর্ষক?
মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক ড. স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান একটি গবেষণার জন্য ৫০জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নেন৷ সেখানে তিনি বুঝতে পারেন যে, কয়েকটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বা ভাষা বা ধর্মগোষ্ঠী থেকেই উঠে আসবে ধর্ষকামী চিন্তা, তা নয়৷ ধর্ষক উঠে আসতে পারে যে কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে৷ পাশাপাশি এক ধর্ষক থেকে আরেক ধর্ষকের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করেন তিনি৷ ধর্ষণের উদ্দেশ্যও সেখানে থাকে ভিন্ন৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু চারিত্রিক মিল
ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, প্রতিটি ধর্ষণের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ এর মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সার্বিক সহানুভূতির অভাব৷ এছাড়া, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ধর্ষকদের মধ্যে নিজের অপরাধের প্রতি ঔদাসীন্য লক্ষ্য করেন৷
ছবি: Getty Images
ধর্ষণ করে ‘জাতে ওঠা’!
গবেষক শেরি হামবি বলেন, ‘‘তরুণরা যৌন অভিজ্ঞতার সাথে সম্মানকে মেলায়৷ এটিকে এক ধরনের জয় হিসাবে দেখে তারা৷ যাদের বেশি যৌন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়৷’’ এই ‘জাতে উঠতে চাওয়ার’ আকাঙ্খা থেকে ধর্ষণ করাকে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা ক্ষতিকারক পৌরুষের লক্ষণ হিসাবে দেখেন তিনি৷ ওপরের ছবিতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: AFP/Abaad/P. Baz
ধর্ষণ একটি অপরাধ
শেরি হামবি এবং স্মিথিম্যান মনে করেন, ধর্ষণ কোনো বিশেষ মানসিক রোগ নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কোনো কোনো ধর্ষকের মধ্যে বিশেষ কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা গেলেও এমন কোনো নির্দিষ্ট মানসিক রোগের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা ধর্ষণ করতে বাধ্য করে৷
ছবি: Getty Images/China Photos
নানা ধরনের ধর্ষকামী মানসিকতা
ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ধর্ষকের মধ্যে একাধিক ধর্ষকামী মানসিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, বলে জানাচ্ছে সেই গবেষণা৷
ছবি: picture-alliance/F. May
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব
ধর্ষকের মনস্তত্ত্বকে বোঝার উপায় কী হবে, এই প্রশ্ন বিভক্ত করেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার গবেষকদের৷ সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা ধর্ষণকে যৌনতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে একে নিছক ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে দেখেন৷ অন্যদিকে, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের গবেষক র্যান্ডি থর্নহিল ও ক্রেগ পামারের মতে, ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য যৌনতাই৷ ওপরের ছবিতে ব্রাজিলের সাওপাওলো শহরে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ধর্ষণের যত ‘মিথ’
ধর্ষণ বিষয়ে বেশ কিছু মিথ বা ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রেই একটি মিথ কাজ করে, যেখানে ধর্ষক আশ্বস্ত হয় যে, অপর পক্ষ যতই বারণ করুক বা বাধা দিক না কেন, বাস্তবে তারও এতে সম্মতি রয়েছে৷ মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক আন্টোনিয়া অ্যাবের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমন মিথে বিশ্বাসী এক ধর্ষকের বয়ান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Klose
গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
মনস্তত্ত্বের আনাচ-কানাচ নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে বহু গবেষণা৷ এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্ষণকে বুঝতে চাওয়া চেষ্টা৷ বিভিন্ন চিন্তাধারার বা অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন নিজেদের মতো করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে৷ এতে করে গভীরে গিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে ধর্ষণের নানা দিক৷ ধর্ষণ রুখতে ও ধর্ষকের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক চিহ্নিত করতে কাজে লাগানো হচ্ছে এমন গবেষণাকে৷
ছবি: Ambrophoto - Fotolia.com
9 ছবি1 | 9
গত বছর ধর্ষণের ঘটনা কিছুটা কম হলেও এবার করোনা থাকার পরও ধর্ষণ বাড়ছে৷ প্রথম ৯ মাসেই আগের বছরকে ছাড়িয়ে গেছে৷ আর যেহারে ধর্ষণ বাড়ছে তাতে বছর শেষে এই সংখ্যা ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন৷
যে আইন আছে সেই আইনে ধর্ষণের শিকার নারীকে আবারো ধর্ষণের শিকার হতে হয়: শিপা হাফিজ
সরকার বলছে কঠোর আইন আছে, আরো বলছে, ধর্ষকদের কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না; তারপরও পরিস্থিতি এত খারাপের দিকে যাচ্ছে কেন? আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজ বলেন, ‘‘এগুলো ফাঁকা বুলি৷ কিসের কঠিন আইন আছে? যে আইন আছে, সেই আইনে ধর্ষণের শিকার নারীকে আবারো ধর্ষণের শিকার হতে হয়৷ আইন ধর্ষকের পক্ষে৷ শুধু যে ঘটনাগুলো আলোচনায় আসে, যেগুলো নিয়ে মানুষ কথা বলে, সেখানেই কিছুটা বিচার পাওয়া যায়৷ সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলের ঘটনা নিয়ে মানুষ কথা বলছেন, তাই এখানে হয়তো বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷’’
এই মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, ‘‘সিলেটের ঘটনার পর ওবায়দুল কাদের সাহেব বললেন, ‘এইসব অন্যায়’৷ তিনি ধর্ষণ শব্দটা মুখে আনলেন না৷ এইসব অন্যায় কি? রেপকে আমরা রেপ হিসেবে দেখছি না৷ অনেক হালকাভাবে দেখছি৷’’ তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘‘ ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি বিদেশি হায়েনা, আর এখন পুরো দেশটাই হায়েনায় ভরে গেছে৷’’
ধর্ষণে শীর্ষ ১০ দেশ
বিশ্বের ৩৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন৷ এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হলেও চুপ থাকেন, ১০ শতাংশ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেন৷ এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে কোন দেশে কতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
সাউথ আফ্রিকা
দেশটির প্রতি এক লাখের মধ্যে ১৩২ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের জরিপ অনুসারে, প্রতি চারজনের মধ্যে একজন ধর্ষণ করে সেই কথা স্বীকারও করেন৷
ছবি: Reuters
বোতসোয়ানা
দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ বোতসোয়ানায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ দেশটির প্রতি এক লাখ নারীরর মধ্যে ৯৩ জন ধর্ষণের শিকার হন৷
ছবি: picture alliance/AA/K. Mathe
লেসোথো
দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক দেশ লেসোথোয় ২০১৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ সেখানকার এক লাখ নারীর মধ্যে ৮৩ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ২৫ হাজার ২৬৮ জন৷
ছবি: Imago/F. Stark
সোয়াজিল্যান্ড
সোয়াজিল্যান্ডে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৭৮ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার এই দেশটির জনসংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ১৩০ জন৷ সেই হিসেবে ২০১৯ সালে এ দেশে ৮৯৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaene
বারমুডা
দেশটির প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬৭ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ অনেক দেশেই যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতারিবোধী আইন থাকলেও নানান অসঙ্গতিতে তা ঠিকমতো প্রয়োগ হয় না৷
ছবি: pictureäalliance/dpa/A. Simmons
সুইডেন
ইউরোপের এই দেশটিতে প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬৩ জনেরও বেশি নারী ধর্ষিত হন৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও বিশ্বজুড়ে পুরুষরাও প্রতিদিন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/A. Tamboly
সুরিনাম
দক্ষিণ অ্যামেরিকার দেশ সরিনামের প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৪৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়৷ দেশটিতে পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ২৭২ জন মানুষ বসবাস করে৷ গত বছর দেশটিতে ২৬২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/E.Troon
কোস্টা রিকা
মধ্য অ্যামেরিকার দেশ কোস্টা রিকার প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩৭ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ গবেষণা বলছে, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের নারীদের ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: Reuters/J.C. Ulate
নিকারাগুয়া
মধ্য অ্যামেরিকার এই দেশটির প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ন৩২ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫০২ জন৷ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম বলছে, অনেক নারী যৌন সহিংসতার ঘটনা নিয়ে অভিযোগই করেন না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Ocon
গ্রেনাডা
ক্যারিবীয় এই দেশটির প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৩১ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা এক লাখ ১২ হাজার তিনজন৷ ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি কলেজ ছাত্রীরাও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Camara
অন্যান্য
১১৮টি দেশের মধ্যে চালানো এই জরিপে ১৪তম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৪০তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ ৪২তম অবস্থানে থাকা জার্মানিতে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৯ জনেরও বেশি ধর্ষিত হন৷ আর ভারতের প্রতি লাখ নারীর মধ্যে এক দশমিক ৮ জন ধর্ষণের শিকার হন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
11 ছবি1 | 11
কিছু মামলায় নিম্ন আদালতে বিচার হলেও শেষ পর্যন্ত তা উচ্চ আদালতে আটকে যায়৷ আপিলের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে৷ ফলে এক যুগেও বিচার শেষ হয় না বলে নিনা গোস্বামী জানান৷ আর ধর্ষণ মামলার আসামিরা তখন বুক ফুলিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়৷ যারা আইনের ফাঁক গলিয়ে ছাড়া পায় তারাও নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে৷ ধর্ষণের শিকার নারীর ওপর নেমে আসে আরেক ধারাবাহিক সামাজিক ধর্ষণের পর্ব৷
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যে প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে তা বলা যায়: অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
২০১৬ সালের মার্চে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার এখানো তদন্তই শেষ হয়নি৷ ২০১৭ সালের মর্চে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার কবে শেষ হবে তা এখনো অনিশ্চিত৷ এই মামলার আসামিরা খুবই প্রভাবশালী৷ ২০১৭ সালের নভেম্বরে টাইঙ্গাইলে বাসে রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত দ্রুতই রায় দেন৷ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চার জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়৷ কিন্তু এখন মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিলে আটকে আছে৷
এভাবে ঝুলে থাকে ধর্ষণ মামলাগুলো৷ আর নিম্ন আদালতে রায় হলেও উচ্চ আদালত হয়ে চূড়ান্ত রায় পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়৷ শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন তাসনিম রহমান ধর্ষণ ও হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় পেতে ১৮ বছর লেগেছে৷ চূড়ান্ত রায়ে ২০১৬ সালের আগস্টে একজনের মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে৷ ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে শাজনীনকে ঢাকায় তাদের নিজ বাসায় ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়৷
যৌন লালসার বিকৃত রূপ
পাঁচ-ছয় বছরের শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধা, কেউ বাদ যাননি ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে৷ ঘর, গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই ঘটেছে এসব ঘটনা৷ ছবিঘরে দেখে নিন যৌন লালসার এমন বিকৃত রূপের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
লালসার শিকার ছয় বছরের সায়মা
রাজধানীর ওয়ারীতে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ছয় বছরের শিশু আফরিন সায়মা৷ সম্প্রতি এই ঘটনা ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে৷ ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর তার বাবার আবেগধর্মী বক্তব্যে আলোড়িত হয়েছেন সবাই৷
এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, নিজের প্রতিবেশও কতোটা অনিরাপদ নারী ও শিশুর জন্য৷
ছবি: bdnews24.com
১২ ছাত্রীর ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আল আমিন৷ গ্রেপ্তার আল আমিন ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
শত বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ!
মে মাসে টাঙ্গাইলে শত বছর বয়সি অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে৷ ওই কিশোর বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে মুখ বেঁধে তাঁকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় পুলিশ৷ গ্রেফতার কিশোর সোহেল ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
আগুনে পুড়ল নুসরাত
ফেনীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জেরে আগুনে পুড়তে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে৷ অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ওই কাণ্ড ঘটায়৷ নুসরাতকে হত্যার আগে নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও হতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জ আর ফেনীর ঘটনা প্রকাশ করছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনিরাপদ নারীরা৷
ছবি: picture-alliance/M. Rashid
রাজনীতির বিরোধে ধর্ষণ!
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়৷ এরপর নোয়াখালীতেই আরেকটি ভোট কেন্দ্র করে ছয় সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণে রাজনীতির সংযোগ নারীর জন্য সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণই করছে৷ এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ছয় মাসে ভিকটিম ৩৯৯ শিশু
মানবাধিকার সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে আটজন ছেলে শিশু রয়েছে৷ ধর্ষণের পর ১৫জন মেয়ে শিশু ও এক ছেলে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ছয় মাসে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য৷
ছবি: Bilderbox
পাঁচ মাসে ৩০০ মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি৷ আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
কিনারা হয়নি তনু হত্যার
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি৷ তনুর পরিবারের অভিযোগ, স্থবির হয়ে আছে তদন্তকাজ৷ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ তনুর পরিবারের৷
ছবি: Twitter
আলোচিত রূপা হত্যা
২০১৭ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ওই মামলায় চারজনকে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
ক্রসফায়ার কি সমাধান?
ধর্ষককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে৷ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতেও দেখা গেছে৷ এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার ধর্ষককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ৷ আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রমাণ হিসাবে দেখা দিয়েছে এসব ঘটনা৷
ছবি: Getty Images/N. Seelam
10 ছবি1 | 10
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘মডারেট মুসলমানের দেশে ধর্ষণ এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণ যদি একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যায়, তার চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! আমাদের সবার উচিত লজ্জায় মুখ ঢাকা৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘যে দেশে ৯৭ ভাগ ধর্ষণের মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যায়, সে দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যে প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে, তা বলাই যায়৷’’
এই বিচারহীনতাকে কেউ কেউ আবার ‘মিথ্যা’ ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যান হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন৷ তারা বলতে চান, ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা৷ এ প্রসঙ্গে আইনের এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘বিচারহীনতার সুযোগে কেউ কেউ এ ধরনের কথা বলতেই পারেন৷ প্রায় অকার্যকর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কারণেই অপরাধীরা ছাড়া পাচ্ছে৷ কিন্তু নারী যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তা তো আর মিথ্যা নয়৷ তাই যদি হবে, তাহলে আদালতে পুলিশ চার্জশিট দেয় কীভাবে? আসল কথা হলো, আমাদের আইনে তো সমস্যা আছেই, মূল্যবোধও নষ্ট হয়ে গেছে৷ তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷’’