ধর্ষককে নয়, ধর্ষিতাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি কলকাতার এক রেস্টুরেন্টে৷ ধর্ষিতার নাম সুজেট জর্ডান৷ রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আবার ঝড় তুলেছেন প্রতিবাদী এই নারী৷
বিজ্ঞাপন
২০১২ সালে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের শিকার হন সুজেট জর্ডান৷ ভারতীয় আইন অনুযায়ী, কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তাঁর নাম গোপন রাখতে হয়৷ সাংবাদিকতা শেখার প্রাথমিক স্তরেও প্রতিটি সাংবাদিক জেনে যান, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধর্ষকের নাম প্রকাশ করা যাবে, তবে ধর্ষিতার নাম কখনোই নয়৷ ধর্ষিতাকে আরো সামাজিক হয়রানি আর অপমান থেকে দূরে রাখতেই এমন নিয়ম৷ তবে সুজেট এ নিয়ম মানেননি৷ ২০১২ সালে সাহস করে স্বনামেই জানিয়েছিলেন ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর৷ চেয়েছিলেন ধর্ষকদের উপযু্ক্ত শাস্তি৷ সেই থেকে সুজেট জর্ডান ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও বেশ পরিচিত৷
শনিবার সেই পরিচিতিই নতুন অপমানের কারণ হলো৷ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সুজেট জানান, শনিবার কলকাতার হাজরা এলাকার রেস্টুরেন্ট কাম পাব ‘জিঞ্জার'-এ গিয়েছিলেন তিনি৷ ঢোকার মুখেই নিরাপত্তা কর্মীরা বাধা দেয়৷ এক পর্যায়ে বলা হয়, ঢুকতে হলে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের অনুমতি নিতে হবে৷ ম্যানেজার সুজেটকে সরাসরি বলে দেন, ‘‘আপনি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ তাই আপনাকে ঢুকতে দেবো না৷ প্রয়োজনে আপনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন৷'' ঘটনাস্থলে অনেকে উপস্থিত থাকলেও কেউ এর প্রতিবাদ না করায় হতাশ এবং ক্ষুব্ধ সুজেট কালিঘাট থানায় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
এদিকে সুজেট ফেসবুকে ঘটনাটি জানানোর পরই শুরু হয়েছে প্রতিবাদ৷ রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি অস্বীকার করেনি৷ এক টেলিভিশন চ্যানেলকে রেস্টুরেন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুজেট ঢুকলে ভেতরে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে – এই ভয়েই প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে৷ দ্য হিন্দু পত্রিকাকে ‘জিঞ্জার'-এর ম্যানেজার উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘একসময় উনি নিয়মিত আমাদের এখানে আসতেন৷ তখন নতুন নতুন পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে এসে মাতাল অবস্থায় খুব ঝামেলা করতেন৷ প্রমান চাইলে আমি ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারবো৷''
সুজেট জর্ডান ম্যানেজারের এ বক্তব্যকে ‘ডাঁহা মিথ্যা' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর দাবি, ঢুকতে না দেয়ার কারণ হিসেবে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ এখন নাকি বকেয়া বিলের কথাও উল্লেখ করছে৷ এ অভিযোগের জবাবে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘টাকা পাওনা থাকলে তো তারা সেই টাকা পরিশোধ করতে বলবে, ঢুকতে বাধা দেবে কেন?''
২০১২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রাতে পাঁচ ব্যক্তি বন্দুকের মুখে ধর্ষণ করে সুজেটকে৷ প্রায় তিন বছর পর সেই কলকাতা শহরে একই ঘটনার কারণে এক রেস্টুরেন্ট কাম পাব-এ তাঁকে ঢুকতে না দেয়ার ব্যাপারটিকেও ধর্ষণের মতো অপরাধই মনে হচ্ছে সুজেটের কাছে৷ ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘‘মনে হচ্ছে, আবার যেন আমাকে ধর্ষণ করা হলো৷ প্রকাশ্যে, এতগুলো লোকের সামনে আমাকে অপদস্থ করা হলো, অথচ কেউ (এর প্রতিবাদে) টু শব্দটিও করলো না! ''
এ ঘটনায় ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে সমাজকর্মী হরীষ আইয়ার বলেছেন, ‘‘ভারতের জন্য আজ একটি কালো দিন৷ এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ যাঁরা ঘটনাস্থলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের কথা ভাবতেও ঘেন্না লাগছে৷''