ধানের শীষে ভোট দেয়ায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে৷ একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তবে প্রধান অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাকে বাদ দিয়ে মামলা করার অভিযোগও পাওয়া গেছে৷
বিজ্ঞাপন
ওই নারী এখন নোয়াখালী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ তাঁর অটোরিকশাচালক স্বামী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত রবিবার দিবাগত রাত ১২টার পরে আমার বাড়িতে ঢুকে আমার স্ত্রী-কে ধর্ষণ করে৷'' তিনি জানান, ধর্ষকরা রুহুল আমীন নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার লোক৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘রবিবার সকাল ১১টায় চর জুবিলী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান আমার স্ত্রী৷ সেখানে সে ব্যালট পেপার নিয়ে বুথে যেতে চায়৷ ওই সময় তারা তাকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেন৷ কিন্তু, সে জানায়, সে ধানের শীষে ভোট দিয়েছে৷ তখন ব্যালট পেপারটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তারা৷ এর মধ্যে আমার স্ত্রী ব্যালটটি বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়৷ তখন তারা বলে, এখন কিছু করবো না, রাতে হিসাব হবে৷''
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘রাত সাড়ে বারোটার দিকে তারা পুলিশ পরিচয়ে ঘরে ঢোকে৷ তারা বলে, আমরা থানা থেকে এসেছি৷ দরজা খুলে সালাউদ্দীন আর সোহেলকে দেখে আমার স্ত্রী তাদের বলে, আসেন, বসেন, পান খান৷তারা বলে ওঠে কিসের পান? তোর সঙ্গে কিসের সম্পর্ক?এ কথা বলেই তাকে বাড়ি দেয়৷’’এরপর তারা তাকে বাইরে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেবলে ধর্ষিতার স্বামী জানান৷
'তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে ঘরে ঢুকে আমার স্ত্রী-কে ধর্ষণ করে'
তিনি আরো জানান, প্রতিবেশী, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনকে আগে এক নির্বাচনে ভোট না দিয়ে খলিল মেম্বারকে ভোট দেয়ায় রুহুল আমিন তাঁকে মারধর করেছিলেন৷
ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতিবেশী এবং আত্মীয় মামুন জানান, ‘‘রুহুল আমীন সুবর্ণচর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক৷ ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষণের পর প্রথমে মাইজদী হাসপাতাল এবং পরে নোয়াখালী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ ঘটনার পর থানাকে জানালেও থানা তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাঁর স্বামী এবং ছেলেকে থানায় নিয়ে আটক রাখে৷ পরে সাদা কাগজে সই নিয়ে ছেড়ে দেয়৷''
‘ধর্ষণ মামলা হওয়ার পর আমরা একজনকে গ্রেপ্তার করেছি’
এই ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশ একটি ধর্ষণ মামলা নিয়েছে৷ কিন্তু ওই মামলায় রুহুল আমীনকে আসামি করা হয়নি৷ এ ব্যাপারে সুবর্ণচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণ মামলা হওয়ার পর আমরা একজনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ আরো আসামি আছে৷ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷'' তবে তিনি জানান, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীনকে আসামি করা হয়নি৷'' তাঁর দাবি, ‘‘মামলার বাদী ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামীই তাকে আসামি করেননি৷ আমরা কী করতে পারি! তবে তদন্ত চলছে৷''
তবে ওই নারীর স্বামী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, আমি পুলিশকে সেভাবেই বলেছি৷ এখন শুনছি, তাকে আসামি করা হয়নি৷ আমাকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়৷ এখন আমি কী করব জানি না৷''
রুহুল আমীন ডয়চে ভেলের কাছে নিজেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক বলে দাবি করেন৷ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হনিফ চৌধুরীও বিষয়টি নিশ্চিত করেন৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে রুহুল জড়িত না৷ তার মানহানির জন্য একটি মহল তার নাম জড়াচ্ছে৷'' আর রুহুল আমীন দাবি করেন, ‘‘ভোট কোন্দ্রে ওই নারীর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি, হুমকি তো দূরের কথা৷ ধর্ষণের ঘটনায় আমার নাম ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়ানো হচ্ছে৷ তারা তো আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়৷ আমি জানি, ওই বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে৷''
‘ভোট কেন্দ্রে ওই নারীর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি’
ধর্ষণের শিকার ওই নারীর শারীরিক অবস্থা এখন খুব খারাপ৷ তাঁকে প্রচণ্ড মারধরও করা হয়েছে৷ ঘটনার পর তাঁর যে ছবি ও ভিডিও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে, তাতে তাঁর শরীর রক্তাক্ত দেখা যায়৷ নোয়াখালী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ৷ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন আছে৷ তাঁর প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা করেছি৷ প্রতিবেদন পাওয়ার পরই ধর্ষণের ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে৷''
তদন্ত করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নোয়াখালীতে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে এক নারীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা আমরা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছে৷ আমরা এই ঘটনাটি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ আমরা তদন্তের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো৷''
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷