রাতের আকাশে গ্রহ-তারার ভিড়ে আচমকা ঝাঁটার মতো দেখতে ধূমকেতু দেখে মানুষের মনে বিস্ময়, আতঙ্ক – কত কিছুই না সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষের পাঠানো যান সরাসরি ধূমকেতুর দোরগড়ায় পৌঁছে অভিনব এক জগত উন্মোচন করছে৷
বিজ্ঞাপন
‘চুরি'-র মতো অন্য কোনো ধূমকেতু নিয়ে এত গবেষণা হয়নি৷ রোসেটা নামের একটি মহাকাশযান সেটিকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে৷ ‘চুরি'-র ভূপৃষ্ঠ গর্তে ভরা, উত্তাপ-নিরোধক একটি স্তরে ঢাকা৷ সূর্যের আলোর মাত্র ৬ শতাংশ প্রতিফলন ঘটায় ‘চুরি'৷ ফলে এই মহাজাগতিক বস্তুটি খুবই অন্ধকার৷
এখনো পর্যন্ত গবেষকরা এই অসাধারণ মহাজাগতিক বস্তুর সৃষ্টির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন৷ ‘চুরি' কি আসলে কোনো বড় বস্তু ছিল, যা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে অনেকটা অংশ হারিয়ে ফেলেছে? নাকি দু'টি ভিন্ন বস্তুর ধাক্কার ফলে এটি সৃষ্টি হয়েছিল? মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের ড. হলগার সিয়র্কস বলেন, ‘‘গত কয়েক মাসে যে এই দু'টি অংশের মধ্যে যে কোনো বড় পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি, তা বেশ বিস্ময়কর৷ আমরা ধূমকেতুর উপরিভাগ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছি, দু'টির উপরেই গর্তে ভরা, ফোলা স্তর রয়েছে৷ আছে খাড়া খাদও৷''
‘চুরি'-র উপর ১৯ রকমের ভূখণ্ড খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা৷ মিশরের দেব-দেবীর নামে সেগুলির নামকরণ করা হয়েছে৷ এই ধূমকেতুর মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাব নেই৷ আছে অদ্ভুত দেখতে পাহাড় ও গর্তে ভরা এলাকা এবং চড়াই-উতরাই৷ ভূ-পৃষ্ঠ সম্ভবত প্রায় এক মিটার উঁচু ধুলার স্তর দিয়ে ঢাকা৷ চারিদিকে পড়ে আছে বিশাল সব পাথর৷ বালির টিলাও দেখা যায়৷ তবে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, ধূমকেতুর উপর কোনো বাতাস বয় না৷ বিষয়টি বেশ রহস্যজনক৷
রহস্য গোল গর্তগুলিকে ঘিরেও, যেগুলি ১৮০ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে৷ তাতে ধুলা জমা হয়৷ সেগুলির দেয়ালে রয়েছে তথাকথিত ‘গুজ বাম্প'
শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু আইসন আর নেই!
ছবি: Reuters
মর্মান্তিক বিদায়
যুক্তরাষ্ট্রের সৌর পদার্থবিদরা ধূমকেতু আইসনের গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন৷ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় যখন সূর্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছায় এটা, তখন তারা এটিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল ধূমকেতু হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে নাসা টুইটারে জানায়, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আইসন আর নেই৷ টেলিস্কোপে সূর্যের পাশে বিশালাকার বরফ ও ধুলোর জায়গায় কেবল একটি ক্ষীণ স্রোতরেখা দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
তীব্র তাপই মৃত্যুর কারণ
বৃহৎ আকার সত্ত্বেও, আইসন সম্ভবত সূর্যের কাছাকাছি এসে তীব্র তাপ ও তাপস্রোত সইতে না পেরে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে৷ ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, গ্রিনিচ মান সময় ২১:৩০ মিনিটে আইসন নিশ্চিহ্ন হয়েছে৷ ইএসএ টুইটারে জানিয়েছে, সোহোতে অবস্থানরত আমাদের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন আইসন আর নেই৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু
সাম্প্রতিক কালে দৃশ্যমান বিভিন্ন উজ্জ্বল ধূমকেতুর মধ্যে আইসন অন্যতম৷ অনেকে এটিকে শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু আখ্যা দিয়েছেন৷ ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের (আইএসওএন) মাধ্যমে ধূমকেতুটি আবিষ্কার করা হয়েছে বলে এটির নাম দেওয়া হয়েছে সি/২০১২ এস১ (আইএসওএন বা আইসন)৷
ছবি: Reuters
বৃহদাকার ধুমকেতু
১৪ মাস আগে এই ধূমকেতুটিকে আবিষ্কৃত হয়৷ এরপর এটিকে নিয়ে অনেক আশা ছিল জ্যোর্তিবিদদের৷ আইসনের বয়স ৪৬০ কোটি বছর বলে ধারণা করা হয়৷ আইসন অন্যান্য ধূমকেতুর তুলনায় বেশ বড়৷ এর পরিধি এক কিলোমিটারেরও বেশি৷
ছবি: cc-by/LarryBloom
টিকে থাকা নিয়ে সংশয় ছিল
আগেই প্রশ্ন উঠেছিল, সূর্যের কাছাকাছি গেলে ধূমকেতু আইসন বাঁচবে কিনা৷ তবে, সূর্য থেকে মাত্র ১০ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব দিয়ে যাওয়ার সময়ই এটি ধ্বংস হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সূর্যকে অতিক্রম করার সময় ২৭৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে মহাকাশে ভস্মীভূত হয়৷ এর আগে অন্য কোন ধূমকেতু সূর্যের এত কাছ দিয়ে যায়নি৷
ছবি: picture alliance / dpa
বাংলাদেশ থেকে দেখা
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আইসন ধূমকেতু শনাক্ত করা হয়েছে এ বছরের নভেম্বরে৷ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া গ্রাম থেকে ৩ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় আইসন শনাক্তকরণের পাশাপাশি ধূমকেতুটির একটি ছবি তোলা হয়৷ বাংলাদেশের বিজ্ঞান সংগঠন অনুসন্ধিৎসু চক্রের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে সেই ছবিটি তোলা হয়েছিল৷
ছবি: Anushandhitshu Chokro Science Organization
লভজয়ের পরিণতি
সৌরমণ্ডলের একেবারে দূর প্রান্তের বরফ-ঠাণ্ডা এলাকা ‘উর্ট ক্লাউড’ থেকে এসেছিল ধূমকেতু আইসন৷ ধূমকেতুটি ঘণ্টায় ১০ লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু শক্তিধর নক্ষত্র সূর্যের তেজের কাছে শেষ পর্যন্ত টিকল না এটি৷ পরিণতি হলো ধূমকেতু লভজয়ের মতোই৷ ২০১১ সালে সূর্যের কক্ষপথের কাছে এসে ধ্বংস হয়ে যায় লভজয়৷
ছবি: NASA/Don Davis
ধূমকেতু কি?
ধূমকেতু হলো ধুলো, বরফ ও গ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক পদার্থ৷ এটি সৌরজাগতিক বস্তু বা সূর্যের খুব কাছ দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়, কখনো কখনো তার লেজ প্রদর্শণ করে৷ এটি প্রস্থে কয়েকশ’ মিটার থেকে দশ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্যে কয়েকশ’ কোটি কিলোমিটার পর্যন্ত হলে পারে৷
ছবি: NASA/Science dpa
হ্যালির ধূমকেতু
প্রতি ৭৫-৭৬ বছর পর পর পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হয়ে উঠা একটি ধূমকেতু হ্যালি৷ বিখ্যাত ইংরেজি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে৷ এর অফিসিয়াল ডেসিগনেশন হচ্ছে ১পি/হ্যালি৷
ছবি: AP
9 ছবি1 | 9
, গায়ে কাঁটা দিলে যেমনটা দেখা যায়৷ গবেষকরা জানতে চান, সেগুলি ধূমকেতুর অক্ষত মৌলিক অংশ কিনা৷ ড. সিয়র্কস বলেন, ‘‘এই ‘গুজ বাম্প' কি সত্যি আদি লগ্নে অনেকগুলি আলাদা টুকরোর সমষ্টির লক্ষণ? গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘের মধ্যে যখন প্রথম ভূ-খণ্ড সৃষ্টি হচ্ছিল, তখনই কি এই দানাগুলি জমাট বেঁধেছিল?''
সেটা প্রমাণিত হলে বিজ্ঞান জগতে হইচই পড়ে যাবে৷ রোসেটা যানের মধ্যে ধূলিকণার নমুনা নিয়ে বিশ্লেষণেরও ব্যবস্থা আছে৷ গবেষকরা প্রায় ৩,০০০ ধূলিকণা সংগ্রহ করেছেন৷ মানুষের চুলের অর্ধেক মাপের কণাগুলি নথিভুক্ত করা হয় ও প্রত্যেকটির আলাদা নামকরণ করা হয়৷ তবে ধুলার মধ্যে বরফ পাওয়া যায়নি, সেগুলি অত্যন্ত শুকনো৷ এগুলি তুষারের মতো হালকা ও পাতলা৷ পার্টিকেলগুলির মধ্যে অনেক ন্যাট্রিয়াম রয়েছে এবং সেগুলি জড়ো করলেই ভেঙে পড়ে৷ নমুনায় জল থাকলে গবেষণাগারের পরীক্ষায় এমন দাগ দেখা যায়৷ কিন্তু ‘চুরি' ধূমকেতুর ধূলিকণায় তা পাওয়া যায়নি৷
এই ধূমকেতুর গলার দিকটাই বেশি সক্রিয়৷ সেখান থেকেই ‘চুরি' বিশাল মাত্রার গ্যাস ও ধূলিকণা মহাকাশে ঠেলে দিয়েছে৷ মাস দুয়েক ধরে ধূমকেতুর শরীরে বেশি করে জেট স্রোত দেখা গেছে৷ আলোর ছটাও বদলে যাচ্ছে৷ অদূর ভবিষ্যতে গলার অংশটি ছায়ার আড়ালে চলে যাবে৷
অন্যদিকে দক্ষিণ দিকে সূর্যের রশ্মির ছটা বেড়ে যাবে৷ ড. সিয়র্কস বলেন, ‘‘এই অংশটি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠবে৷ দক্ষিণ গোলার্ধে যে অংশে সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো পড়বে, আমরা সেটি এখনো পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি৷ আমরা গভীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছি৷''
‘চুরি' ধূমকেতু তার দক্ষিণে ২০ মিটার পর্যন্ত জায়গা হারাতে পারে৷ এমনটা হলে গবেষকরা তার গভীরে আরও প্রাচীন অংশ দেখতে পাবেন বলে আশা করছেন৷