‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' – সিগারেট প্যাকেট, সিনেমার পর্দা, সর্বত্র পড়া যায় এই সতর্কবাণী৷ ক্ষতির মাত্রা শুধু ক্যানসারের আশঙ্কা নয়, জার্মান বিজ্ঞানীরা বংশবৃদ্ধির উপর এর মারাত্মক প্রভাব প্রমাণ করতে পেরেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর৷ প্রত্যেকেই প্রথমে ফুসফুসের ক্যানসারের কথা ভাবেন৷ কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, তামাকের ধোঁয়া পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার উপরও প্রভাব ফেলতে পারে৷ অন্যদের তুলনায় ধূমপায়ী পুরুষের বীর্যের ‘মোবিলিটি' ও টিকে থাকার ক্ষমতা অনেক কম৷
জার্মানির সারলান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ধূমপায়ীদের বীর্যকোষের জিনোমের মেমব্রেনে পরিবর্তন প্রমাণ করতে পেরেছেন৷ অর্থাৎ যে পুরুষ সন্তানের পিতা হতে চান, তাঁদের ধূমপান এড়িয়ে চলা উচিত৷ বায়োকেমিস্ট অধ্যাপক মাটিয়াস মন্টেনার বলেন, ‘‘সিগারেটের ধোঁয়ায় এমন পদার্থ থাকে, যা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জিনোম পরিবর্তন করে৷ ফলে তা আর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না৷ তাছাড়া বীর্যের আকার, ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছানোর গতি বদলে যায়৷ ফলে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে৷ এ কারণেই অনেক ধূমপায়ী সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না৷''
এছাড়া গবেষকরা ধূমপায়ীদের বীর্যের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মাত্রার কোটিন খুঁজে পেয়েছেন, যা নিকোটিন ভেঙেই তৈরি হয়৷ এর অন্যতম পরিণাম হলো, ধূমপানের ফলে বীর্যকোষের ‘ফিটনেস'-এর ক্ষতি হয়, যা স্পষ্ট দেখা যায়৷ বামে অ-ধূমপায়ী আর ডাইনে ধূমপায়ীদের বীর্য রাখলে এই তফাত চোখে পড়ে৷
‘ধূমপান বর্জন করুন, ক্যানসারকে দূরে রাখুন’
ফুসফুসের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ধূমপায়ী
ছবি: Fotolia/Fotowerk
ধূমপান – বিষপান
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সে কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা৷ তবে ধূমপান স্বাস্থ্যের ঠিক কতটা ক্ষতি করে, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই৷ জার্মানির ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ধূমপান করার কারণেই বছরে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়৷ আর বছরে ৩,৩০০ জন মারা যায় ধূপায়ীদের কাছাকাছি থেকে সিগারেটের ধোঁয়া গ্রহণ করার কারণে৷
ছবি: AP
ফুসফুসের ক্যানসার
ধূমপান শরীরের যে কোনো অঙ্গেরই ক্ষতি করে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুস এবং হার্ট বা হৃদযন্ত্রের৷ ফুসফুসের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ধূমপায়ী৷
একদিনে দুই কোটিরও বেশি সিগারেট
জার্মানিতে মানুষ দিনে প্রায় আড়াই কোটি সিগারেট খায়৷ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২৫ জন নিয়মিত ধূমপান করেন, মাঝে মাঝে করেন শতকরা চারজন৷ তার মধ্যে শতকরা ৩৫ জন পুরুষ এবং ২২ জন নারী৷ জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ ক্ষেত্রের শ্রমিক, বাস বা ট্রাক চালক৷ আর সবচেয়ে কম ধূপায়ীদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, ফার্মেসি কর্মী এবং শিক্ষক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে
গত ২০ থেকে ৩০ বছরে জার্মানিতে মহিলাদের মধ্যে ধূমপান করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে৷ জার্মানিতে মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে বেশি৷ তবে এখন মহিলারা যেভাবে ধূমপান করেন, তা অব্যাহত থাকলে শীঘ্রই মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের সমান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: Picture-Alliance/KEYSTONE
সিগারেটের বিজ্ঞাপন অনেকটা দায়ী
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপান উপভোগ করার চেয়ে স্মার্টনেস দেখানোই যেন বড় কথা৷ তবে সিগারেটের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনই এদের ধূমপান করতে প্রভাবিত করে থাকে৷ সুখের কথা, জার্মানিতে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সম্মিলিত প্রচেষ্টা
ধূমপান ছেড়ে দেওয়া সহজ নয়, তবে চেষ্টা করলে পারা যায়৷এর জন্য রয়েছে নানা ওষুধপত্র,গ্রুপ থেরাপি৷মনোবিজ্ঞানী, গবেষক এবং কেমনিৎস শহরের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধূমপান বিরোধী কেন্দ্রের প্রধান প্রোফেসার স্টেফান ম্যুলিশ বলেন, ধূমপান ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকেই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমতে শুরু করে৷তিনি একটি গ্রুপ থোরাপিও পরিচালনা করেন৷তাঁর মতে, ‘একা চেষ্টার চেয়ে গ্রুপের মাধ্যমে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টায় সফলতা বেশি’৷
ছবি: Privat
ঘরের বাইরে ধূমপান
বেশ কয়েক বছর থেকে জার্মানিতে বিভিন্ন জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷বিভিন্ন রেস্তোরাঁ বা অফিস-আদালতের মতো ডয়চে ভেলেতেও অফিস ঘরে ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ৷ তবে ঘরের বাইরে, অর্থাৎ বারান্দায় প্রায়ই কর্মীদের ধূমপান করতে দেখা যায়, এমনকি বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি হলেও৷
ছবি: picture-alliance/Coleman/Photoshot.
প্রোফেসর ড. এলিজাবেথ পট
‘ধূমপায়ীরা মাত্র কয়েক সপ্তাহ ধূমপান থেকে বিরত থাকুন৷ নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে আপনাদের ফুসফুস আরো ভালোভাবে কাজ করছে’৷ একথা বলেছেন প্রোফেসর ড. এলিজাবেথ পট, যিনি ১৯৮৬ সাল থেকে জার্মানির স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় দফতরের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন৷
ছবি: dapd
শেষ কথা
মানুষ তার আয়ু নিজেই নির্ধারণ করতে পারেনা তা ঠিক, তবে ধূমপান করে ইচ্ছে করে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবারও কোনো যুক্তি নেই৷ শুধু তাই নয়, যারা ধূপায়ীদের আশেপাশে থাকে তারা আক্রান্ত হয় স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায়৷ আর সন্তানসম্ভবা মায়েরা ধূমপানের সময় ভাবুন তাদের অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের কথা৷ এমনটাই বলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Fotolia/Fotowerk
9 ছবি1 | 9
তামাকের ধোঁয়ার ফলে শরীরে এমন সব ‘ফ্রি ব়্যাডিকাল' বা আগ্রাসী ক্ষুদ্র পার্টিকেল তৈরি হয়, যা শরীরের অন্যান্য অণুর সংস্পর্শে এলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ঘটে৷ ফলে সেই অণুগুলির ক্ষতি হয়৷ অধ্যাপক মন্টেনার বলেন, ‘‘বীর্যের মধ্যে যে ‘ফ্রি ব়্যাডিকাল' সৃষ্টি হয়, তা ফ্যাটি অ্যাসিড বদলে দেয়৷ এর ফলে মেমব্রেনও নষ্ট হয়ে যায়৷ তাছাড়া এই ব়্যাডিকাল কোষের মূলে গিয়ে জিনোম বদলে দেয়৷ এর পরিণাম সাংঘাতিক৷ কারণ পরে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার সময় তাতে বিকৃতি দেখা দিতে পারে অথবা প্রক্রিয়াটি আদৌ ঘটতেই না পারে৷''
‘ফ্রি ব়্যাডিকাল' ডিএনএ – অর্থাৎ বীর্যকোষের ক্রোমোজোমের উপর হামলা চালালে তার খোলস নষ্ট হয়ে যায় এবং ক্রোমোজোম ভেঙে যেতে পারে৷
সারলান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহম্মদ হামাদেহ তাঁর ‘রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন' বিভাগে বীর্য পরীক্ষা করে এমন প্যাথোলজিকাল পরিবর্তন পরীক্ষা করেন৷ এক পরীক্ষার মাধ্যমে বীর্যকোষের অবস্থা বোঝা যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘দাগ সহ বীর্য এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে৷ যাতে দাগ নেই, সেই বীর্য স্বাভাবিক৷ ‘টানেল টেস্ট'-এর মাধ্যমে তা জানা গেছে৷ যে বীর্যের ডিএনএ ভেঙে গেছে, তা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না৷''
পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ধূমপান একটা বড় বিষয়৷ এক্ষেত্রে ‘প্যাসিভ স্মোকিং' সরাসরি ধূমপানের মতই ক্ষতিকর৷ সিগারেট দূরে রাখলে স্বাস্থ্যকর বীর্যকোষের সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷