সিগারেটের কটূগন্ধে বিরক্ত প্রতিবেশীরা মামলা ঠোকার পর এক বৃদ্ধকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ডুসেলডর্ফের একটি আদালত৷ রায়ে বলা হয়েছে, নিজের বাসায় ধূমপানের ক্ষেত্রে আইনে কোনো সমস্যা নেই৷ তাহলে?
বিজ্ঞাপন
ফ্রিডহেল্ম আডল্ফস কিন্তু তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে বসেই সিগারেট খেয়েছিলেন৷ সমস্যা হলো, সিগারেটের ধোঁয়া হলওয়েতে যাওয়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি৷ আর সেটাই তাঁর অপরাধ৷ তাই এবার, বাড়িওয়ালির নোটিস মেনে নিয়ে তাঁকে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিতে হবে৷
৭৫ বছর বয়সি আডল্ফসের দিন কাটে সরকারের অবসর ভাতার টাকায়৷ গত চার দশক ধরে তিনি ওই বাসায় বসবাস করে এলেও প্রতিবেশীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতবছর তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যান তাঁর বাড়িওয়ালি৷
এ মামলার শুনানিতে বাড়িওয়ালির আইনজীবী আদালতকে বলেন, বার বার অনুরোধ করার পরও আডল্ফস ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাপার্টমেন্টের জানালা খুলতে অস্বীকৃতি জানান৷ এমনকি নিয়মিত অ্যাশট্রে পরিষ্কার করতেও তাঁর ছিল দারুণ অনীহা৷ ২০১২ সালে বাড়িওয়ালি মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেয়ার পরও বৃদ্ধ তাতে কান দেননি৷
বাড়ি ছাড়ার জন্য আডলফসকে এ বছরের শেষ পর্যন্ত সময় দিয়েছে ফেডারেল আদালত৷ অবশ্য এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন৷
জার্মানির ধূমপায়ী-অধূমপায়ী দু'পক্ষই গত এক বছর ধরে সমান আগ্রহ নিয়ে এ মামলার খোঁজ খবর রেখেছেন৷ ধূমপায়ীদের কারো কারো আশঙ্কা, আদালতের এই রায়ের ফলে নিজের বাড়িতে বসে ধূমপানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ তৈরি হতে পারে৷
‘ধূমপান বর্জন করুন, ক্যানসারকে দূরে রাখুন’
ফুসফুসের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ধূমপায়ী
ছবি: Fotolia/Fotowerk
ধূমপান – বিষপান
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সে কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা৷ তবে ধূমপান স্বাস্থ্যের ঠিক কতটা ক্ষতি করে, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই৷ জার্মানির ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ধূমপান করার কারণেই বছরে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়৷ আর বছরে ৩,৩০০ জন মারা যায় ধূপায়ীদের কাছাকাছি থেকে সিগারেটের ধোঁয়া গ্রহণ করার কারণে৷
ছবি: AP
ফুসফুসের ক্যানসার
ধূমপান শরীরের যে কোনো অঙ্গেরই ক্ষতি করে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুস এবং হার্ট বা হৃদযন্ত্রের৷ ফুসফুসের ক্যানসার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ধূমপায়ী৷
একদিনে দুই কোটিরও বেশি সিগারেট
জার্মানিতে মানুষ দিনে প্রায় আড়াই কোটি সিগারেট খায়৷ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২৫ জন নিয়মিত ধূমপান করেন, মাঝে মাঝে করেন শতকরা চারজন৷ তার মধ্যে শতকরা ৩৫ জন পুরুষ এবং ২২ জন নারী৷ জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণ ক্ষেত্রের শ্রমিক, বাস বা ট্রাক চালক৷ আর সবচেয়ে কম ধূপায়ীদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, ফার্মেসি কর্মী এবং শিক্ষক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে
গত ২০ থেকে ৩০ বছরে জার্মানিতে মহিলাদের মধ্যে ধূমপান করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে৷ জার্মানিতে মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে বেশি৷ তবে এখন মহিলারা যেভাবে ধূমপান করেন, তা অব্যাহত থাকলে শীঘ্রই মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের সমান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: Picture-Alliance/KEYSTONE
সিগারেটের বিজ্ঞাপন অনেকটা দায়ী
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপান উপভোগ করার চেয়ে স্মার্টনেস দেখানোই যেন বড় কথা৷ তবে সিগারেটের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনই এদের ধূমপান করতে প্রভাবিত করে থাকে৷ সুখের কথা, জার্মানিতে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সম্মিলিত প্রচেষ্টা
ধূমপান ছেড়ে দেওয়া সহজ নয়, তবে চেষ্টা করলে পারা যায়৷এর জন্য রয়েছে নানা ওষুধপত্র,গ্রুপ থেরাপি৷মনোবিজ্ঞানী, গবেষক এবং কেমনিৎস শহরের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধূমপান বিরোধী কেন্দ্রের প্রধান প্রোফেসার স্টেফান ম্যুলিশ বলেন, ধূমপান ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকেই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমতে শুরু করে৷তিনি একটি গ্রুপ থোরাপিও পরিচালনা করেন৷তাঁর মতে, ‘একা চেষ্টার চেয়ে গ্রুপের মাধ্যমে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টায় সফলতা বেশি’৷
ছবি: Privat
ঘরের বাইরে ধূমপান
বেশ কয়েক বছর থেকে জার্মানিতে বিভিন্ন জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷বিভিন্ন রেস্তোরাঁ বা অফিস-আদালতের মতো ডয়চে ভেলেতেও অফিস ঘরে ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ৷ তবে ঘরের বাইরে, অর্থাৎ বারান্দায় প্রায়ই কর্মীদের ধূমপান করতে দেখা যায়, এমনকি বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি হলেও৷
ছবি: picture-alliance/Coleman/Photoshot.
প্রোফেসর ড. এলিজাবেথ পট
‘ধূমপায়ীরা মাত্র কয়েক সপ্তাহ ধূমপান থেকে বিরত থাকুন৷ নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে আপনাদের ফুসফুস আরো ভালোভাবে কাজ করছে’৷ একথা বলেছেন প্রোফেসর ড. এলিজাবেথ পট, যিনি ১৯৮৬ সাল থেকে জার্মানির স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় দফতরের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন৷
ছবি: dapd
শেষ কথা
মানুষ তার আয়ু নিজেই নির্ধারণ করতে পারেনা তা ঠিক, তবে ধূমপান করে ইচ্ছে করে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবারও কোনো যুক্তি নেই৷ শুধু তাই নয়, যারা ধূপায়ীদের আশেপাশে থাকে তারা আক্রান্ত হয় স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায়৷ আর সন্তানসম্ভবা মায়েরা ধূমপানের সময় ভাবুন তাদের অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের কথা৷ এমনটাই বলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Fotolia/Fotowerk
9 ছবি1 | 9
আদালতের রায় ঘোষণার পরপরই জার্মানির অ্যাসোসিয়েশন অফ রেন্টার্সের পরিচালক লুকাস জিবেনকোটেন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে ধূমপানে কোনো বিধিনিষেধ দেয়া চলে না৷ ফেডারেল আদালত গত বছরই বলে দিয়েছে, একজন ভাড়াটে বাসা নেয়ার সময় যে চুক্তি করেছেন, সে অনুযায়ী ধূমপানের বিষয়টি নির্ধারিত হবে৷''
এ মামলার বিচার চলাকালে আডল্ফস দাবি করেন, সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিটের পরে তিনিই জার্মানির সবেচেয়ে বিখ্যাত ধূমপায়ী৷ তাছাড়া অন্য ধূমপায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তা দিয়েই তিনি নাকি এ মামলা চালিয়েছেন৷
জার্মানির পাবলিক ভবন, পরিবহনসহ বিভিন্ন স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৭ সালে৷ অধিকাংশ বার ও রেস্তোরাঁতেও ধূমপান নিষিদ্ধ৷
এক সময় অক্টোবর ফেস্টের মতো বিয়ার উৎসবে ধূমপান করা গেলেও ২০০৭ সাল থেকে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা চলছে৷ হেলমুট স্মিটই সম্ভবত জার্মানির সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের মধ্যেও সিগারেট ধরানোর মতো স্বাধীনতা ভোগ করেছেন৷