ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা কলকাতা?
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭গত মঙ্গলবার বেলা বাড়তেই তিলোত্তমা কলকাতার চেহারা পালটে যায়৷ আকাশ মেঘলা ছিল, কিন্তু ধোঁয়াশার মতো আবরণ ঘিরে ধরে দিনের কলকাতাকে৷ দিল্লিতে সম্প্রতি এ ধরনের ধোঁয়াশা নিয়ে বিপুল হইচই হয়েছে৷ এবার তেমনই দূষণের থাবা কলকাতায়৷ মার্কিন দূতাবাসের রিপোর্ট জানাচ্ছে, মঙ্গলবারের দূষণে নাকি কলকাতা টপকে গিয়েছে দিল্লিকেও৷ ভোর ৫টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি কলকাতার দূষণমাত্রা ছিল দিল্লির থেকেও বেশি৷ জানা গেছে, পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা অতি সূক্ষ্ম কণার জেরেই এই দূষণ৷
এমন ধোঁয়াশা শেষ কবে শেষ দেখা গেছে, মনে করতে পারেন না কলকাতার বাসিন্দারা৷ রাতের কলকাতাও ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে৷ মঙ্গলবার শহরে উত্তরে হাওয়ার দাপট ছিল কম৷ পাশাপাশি ঘূর্ণাবর্তের জন্য বাতাসে ভাসমান জলীয় বাষ্পের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছিল৷ সে কারণেই সূক্ষ্ম ধূলিকণা জলীয় বাষ্পের আবরণ ঠেলে ওপরে উঠে যেতে পারেনি৷ ফলে চাঁদোয়ার আকারে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা এবং তা দূষণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত৷ এমনটাই মনে করছেন পরিবেশবিদরা৷ কিন্তু এটা কি কোনো আসন্ন সংকটের ইঙ্গিত?
এমনিতে প্রতি বছর অক্টোবর পেরোলেই কলকাতার আকাশে ধোঁয়াশার দেখা মেলে৷ রাজধানী দিল্লির দূষণ বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দেশের অন্যান্য বড় শহর যদি সাবধান না হয়, তা হলে এই বিষ ছড়িয়ে পড়তে দেরি হবে না৷ তবে কি যে কোনো মুহূর্তে দিল্লির মতোই স্তব্ধ হতে পারে কলকাতার জনজীবনও?
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিজ্ঞানী ড. রীতা সাহা অবশ্য এতটা উদ্বেগ আছে বলে মনে করছেন না৷ ফোনে তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এত তাড়াতাড়ি আমরা বলে দিতে পারি না যে দূষণ বেড়ে গেছে৷ দিনরাত আমরা নিয়মিতভাবে দূষণ মাপছি৷ রাতে দূষণমাত্রা ১৮০-র বেশি, ২০০-র কাছাকাছি থাকছে৷ মার্কিন দূতাবাসের একটি স্টেশনের একদিনের উদ্বেগজনক রিপোর্ট দেখে হইচই করা যায় না৷ পুরো কলকাতায় ৩২টি এমন স্টেশন আছে৷ কোথাও এমন দেখা যাচ্ছে না৷''
তবে অভিজ্ঞ এই বিজ্ঞানী স্বীকার করলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে মাত্রাটা বেড়েছে৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য দূষণ পর্যদের তরফে কাজ তো করা হচ্ছেই৷ আমরা নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছি৷ দিল্লি থেকে নিয়মিতভাবে কলকাতার দূষণ নজরে রাখা হচ্ছে৷''
তবে কি কলকাতা নিরাপদ? ড. সাহার মতে, ভৌগোলিক কারণে দিল্লিতে দূষণ হওয়ার যতটা সম্ভাবনা, কলকাতায় ততটা নেই৷ হরিয়ানা-পাঞ্জাবের ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর সমস্ত দূষণটাই দিল্লি দিকে আসছে৷ সে অর্থে কলকাতা সমুদ্রের অনেক কাছাকাছি, দিল্লির মতো বায়ু চলাচলের সমস্যা নেই এখানে৷ সুন্দরবন বা গঙ্গার উপস্থিতি কলকাতাকে অনেকটা নিরাপদ রেখেছে৷ কলকাতার অবস্থানটাই অনেক সুবিধাজনক৷ তাছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দূষণরোধী ছোট ছোট গাছপালা লাগানো হয়েছে৷
কিন্তু বহু কৃত্রিম কারণে হয়ত কলকাতায় আজ ধোঁয়াশার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ তবুও দিল্লির মতো পরিস্থিতি কলকাতায় কোনোদিনই হবে না৷ যে কারণে বহরমপুরের কৃষিদূষণে কলকাতার অসুবিধা হচ্ছে না৷
ইতিমধ্যে কলকাতায় বায়ুদূষণের সম্ভাবনা আছে শুনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে গোটা শহরে৷ রাস্তাঘাটে সতর্ক মানুষেরা অনেকেই মুখে ‘মাস্ক' পরে ঘোরাফেরা করছেন৷ কিন্তু এই মাস্ক কি শরীরের ভেতরে দূষণের প্রভাব ঠেকাতে সক্ষম? কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ কৌশিক চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘মাস্ক পরলে দূষণের প্রভাব কিছুটা তো আটকানো যাবেই৷ তবে একেবারেই সেটা ব্যক্তিগত প্রতিরোধ বলা যেতে পারে৷ পরিবেশ দূষণ আটকানোই প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত৷''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট কলকাতার বাতাসে বিষবৃদ্ধির কথা বলেছে৷ নানা কারণে এই শহরে বাড়ছে বায়ুদূষণ — পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির সে অর্থে ব্যবহার নেই৷ ডিজেল চালিত গাড়ির সংখ্যা কম নয়৷ বাড়ছে নির্মাণ, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও৷ শহরের এমন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ডা. চক্রবর্তী জানালেন, ‘‘মাস্কের প্রকারভেদ আছে৷ অ্যান্টি-পলিউশন মাস্ক ২ দশমিক ৫ মাইক্রনের কম ভাসমান কণা আটকাতে পারে৷ অন্যান্য ধূলিকণা আটকানোর জন্যও মাস্ক কাজ করে৷ মাস্ক ব্যবহার করলে প্রশ্বাসের জন্য নেওয়া বাতাসের মান অনেক ভালো হবে৷''
জাতীয় পরিবেশ আদালতে হলফনামা দিয়ে দূষণের দায় স্বীকার করতে হয়েছে রাজ্য পরিবেশ দপ্তরকে৷ কিন্তু তারপরেও দূষণ ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ৷ এই ক্রমবর্ধমান দূষণের জেরে সৃষ্ট ধোঁয়াশা মানুষের চোখ, নাক, শ্বাসনালী সহ বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ করে৷ হাঁপানি ও হৃদরোগীরা ধোঁয়াশায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ তাই ধোঁয়াশার প্রতিকার ও প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই৷ সিএমআরআই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ডা. চক্রবর্তী রাস্তাঘাটে চোখ, ত্বক ঢেকে চলাফেরার সঙ্গে মাস্ক ও ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন৷ তবে বারবার স্বীকার করেছেন যে ভালো থাকার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই৷
বিজ্ঞানী ড. সাহা অবশ্য দৃষণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট আশাবাদী৷ তিনি জানালেন, ‘‘বায়ুদূষণ এখন সূচক দ্বারা নির্ধারিত হয়৷ দূষণ নিয়ন্ত্রণে অনলাইন মনিটরিং চলছে৷ কোলাঘাটের থার্মাল পাওয়ারপ্ল্যান্টের দূষণকেও এভাবে রোধ করা হয়েছে৷ কলকাতার গাড়ির দূষণকে রোধ করার ব্যবস্থা চলছে৷ তিন-চার বছরের মধ্যে আশা করি তা করে ফেলতে পারা যাবে৷ গাড়ির ধোঁয়া, এলইডি আলোও অনেক সময় আঞ্চলিকভাবেও দূষণের সৃষ্টি করে৷ দীপাবলির সময় যা দূষণ হতো আগে, এখন তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছি৷''
বায়ুদূষণ কি আপনার শহরেও বেড়েছে? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷