1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালো অন্তর্বর্তী সরকার

২৫ জুন ২০২৫

নতুন অর্থবছর শুরুর আগেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় সরকারের ব্যয় মিটাতে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ধার করতে হচ্ছে।

টাকার ছবি
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল পর্যন্ত এক লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি ৫ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে ৯৪ হাজার ৯৩৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকাছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও গত ১৫ জুন পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৯১ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার।

আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রি হ্রাস পাওয়া এবং বৈদেশিক উৎস থেকে কম ঋণ ছাড় হওয়ার কারণে অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কম ছিল। জানুয়ারি পর্যন্ত  সাত মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা দ্রুত গতিতে বেড়ে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেল।

চলতি অর্থবছরে সরকার তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ১.২২ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২২ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। সরকারের ঋণ বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আদায় ও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল পর্যন্ত এক লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি ৫ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে ৯৪ হাজার ৯৩৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

সরকার বেশি নিলে বেসরকারি খাতের সুযোগ কমে: মহিউদ্দিন রুবেল

This browser does not support the audio element.

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন এবং তা পাস হয়েছে। এটা চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫)  মূল বাজেটের তুলনায় সাত হাজার কোটি টাকা কম। ১ জুলাই থেকে নতুন বাজেট কার্যকর হবে। এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, নতুন অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে আরো বেশি ঋণ নেবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ কমে যায়। এতে বিনিয়োগে টান পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ডয়চে ভেলেকে বলেন,"আসলে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সূদ হারের কারণে শুধু পোশাক খাতই নয়, সব শিল্প খাতেই নতুন  করে তেমন বিনিয়োগ হচ্ছে না।  বিনিয়োগ তো করা হয় মুনাফার জন্য। কিন্তু সেই মুনাফার সুযোগ না থাকলে বিনিয়োগকারীরা কেন বিনিয়োগ করবেন?”

তার কথা, " শুধু ব্যাংক ঋণের উচ্চ হার নয়, বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। সামনে নির্বাচনের কথা হচ্ছে। সেটা হলে হয়তো বা তখন বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগের চিন্তা করবেন। আর সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে তো বেসরকারি খাতের সুযোগ কমে যায়।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনই বলছে যে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৫ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪ শতাংশ কম। ওই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা, যা মার্চে ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।

‘এতে বোঝা যায় যে, দেশে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না'

যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, "সরকারকে তার খরচ মিটাতে ব্যাংক থেকে তখনই ঋণ নিতে হয়, যখন তার রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকে। আর সেটা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে নিতে পারে, যেটাকে বলে ‘হাইপাওয়ার্ড মানি'। আর বেসরকারি ব্যাংক খাত থেকে নিতে পারে। এখন যেহেতু বেরসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম, তাই সরকার ব্যাংক থেকে নিচ্ছে।”

এখন বেরসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম: নুরুল আমিন

This browser does not support the audio element.

"কিন্তু এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, এতে বোঝা যায় যে, দেশে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে না, মূল্যস্ফীতি বাড়বে আর সরকারের দায়-দেনাও বাড়বে,” বলেন তিনি।

তার কথা, "বিনিয়োগ কমা আর রাজস্ব আদায় কম হওয়া এই দুই প্রভাবক সরকারকে ঋণ নিতে বাধ্য করছে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সরকারের ব্যাংক ঋণ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেল। এর আগে লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে। সেবার ১.১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার ১.১৯ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। অর্থবছরের মাঝপথে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ করলেও তাতে রাজস্ব আদায়ে খুব একটা সুফল মেলেনি।

বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহে ১৩ শতাংশের মতো কমেছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিটিএডি) সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৫' প্রকাশ করেছে। ১৯ জুন প্রকাশিত এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে নিট বা প্রকৃত বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১২৭ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ প্রবাহ দেশের এক মাসের রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় অর্ধেক এবং বার্ষিক রফতানি আয়ের এক-চতুর্থাংশেরও কম। তুলনামূলকভাবে, ২০২৩ সালে দেশে এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

‘অর্থনীতির গতি ফিরাতে নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে'

অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, "একদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে খরা, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ। আর আছে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি । সব মিলিয়ে সরকার ও ব্যাংকগুলো আর্থিক সংকটে আছে। ”

"চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন। এটা আরো বাড়বে। বছরে যত ঋণ দেয়া হচ্ছে, তার চারভাগের এক ভাগই খেলপি ঋণ। সব মিলিয়ে  সরকারের আর্থিক খাত চাপের মুখে আছে,” বলেন তিনি।

সরকার ও ব্যাংকগুলো আর্থিক সংকটে আছে: মাহফুজ কবির

This browser does not support the audio element.

তার কথা," রিজার্ভ ভালো আছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো। তার মানে, আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সংকটে পড়বো না। আমদানি ব্যয় মেটাতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তাতে তো বিনিয়োগ বাড়বে না।”

আন্তর্জাকি মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য দুই কিস্তিতে আরো ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ছাড় করেছে। ছাড় করা অর্থের মধ্যে প্রায় ৮৮৪ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) ও এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) কর্মসূচির আওতায়। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির জন্য আরো ৪৫৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে।

ড. মাহফুজ কবির বলেন," এই  ঋণের একটি অংশ বাজেটে ব্যবহার করা যাবে। ফলে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে কিছুটা হলেও সহায়তা হবে। কিন্তু অর্থনীতির গতি ফিরাতে একটি নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন,"  আসলে এনবিআরের নানা সমস্যা এবং অদক্ষতার কারণে রাজস্ব আদায় কমে গেছে। অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। কিন্তু সরকারের ব্যয় তো কমেনি। ফলে এখন ব্যাংক থেকে টাকা ধরা করা ছাড়া সরকারের উপায় নেই।”

"আর এখন মধ্যপ্রচ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে জ্বালানি তেল আমদানির খরচ অনেক বেড়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রম বাজারে কোনো সংকট হলে আরো বিপদ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ  কমছে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। এর পরিনতি হলো মূল্যস্ফীতি। রেমিট্যান্স বা রিজার্ভ তো আর বিনিয়োগে যায় না।”

তার কথা, "দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা সবার আগে দরকার। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে আশা করি।”

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, "রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকগুলোর তারল্যের সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। তবে সরকারের স্থিতিশীলতায় এটি আবার বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ