‘নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না’
২০ মার্চ ২০১৮ডয়চে ভেলে: নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য কী?
অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ: নগর উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নগরগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এবং মানুষের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর রেখে যে ভূমি ব্যবহার, সেই ভূমি ব্যবহারটাকে নিশ্চিত করা৷ এখানে বাসস্থান, পরিবহণ থেকে শুরু করে অন্যান্য যে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা আছে, সেগুলো যাতে মানুষের চাহিদা মতো তাদের কাছে দেয়া যায়, সে কারণেই পরিকল্পনা প্রয়োজন৷
একটা সুন্দর নগর গড়ে তোলার জন্য আসলে কী কী থাকা দরকার?
কয়েকটা ‘বেসিক’ জিনিস থাকতেই হবে৷ যেমন বাসস্থান৷ সেটা শুধু থাকলেই হবে না, সেটা যেন মানসম্পন্ন হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে৷ তাছাড়া পরিবহণব্যবস্থা যেন জনবান্ধব হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ অনেক সময় আমরা পরিবহণের যে ব্যবস্থা করি, সেটা জনবান্ধব হয় না৷ এছাড়া অনেক সামাজিক ব্যবস্থা আছে, যেমন খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ, হেলথ সেন্টার – একটি শহরে সেগুলিও থাকতে হবে৷ এগুলোর বিন্যাস যেন সুষ্ঠু হয়৷ মানুষ যেন সহজেই এই সেবাগুলো নিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷
আমরা কি একটা যুগোপযোগী নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি?
আমাদের বিভাগীয় শহরগুলোতে ৬০-এর দশকে এবং পরে ৯০-এর দশকে কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়৷ সময়ের বিবেচনায় তখন হয়ত ওগুলো ঠিক ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর উন্নয়নের ধারণা পরিবর্তন হয়৷ সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নগর উন্নয়নের বিষয়গুলো এর মধ্যে আনতে হয়৷ আমরা যেটা দেখি, পরিকল্পনা যা-ই নেয়া হোক, এর বাস্তবায়ন খুবই কম৷ এ কারণে এটাকে আমরা বাস্তবে দেখতে পাই না৷ সেটা কত ভালো পরিকল্পনা ছিল, সেটা আমরা বুঝতে পারি না৷ আসলে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়নের পরিমাণ খুবই কম৷
বর্তমানে ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় উপরের দিকে উঠে এসেছে৷ এটা আসলে কী বার্তা দিচ্ছে?
আমাদের দেশে সবকিছুই কেন্দ্রমুখী, ঢাকাকেন্দ্রিক৷ আমাদের কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা সবকিছুই রাজধানীমুখী৷ এমনকি রাজনীতিও৷ ফলে আমাদের সব মানুষ ঢাকামুখী হয়ে আসেন৷ এই ঢাকামুখী মানুষের অবিরাম স্রোত – আগে কখনও এটা ঢাকা সামাল দিতে পারেনি, এখনও পারছে না৷ এর অন্যতম কারণ, যে সংস্থাগুলো এর উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, তিতাস – এরা শহরে যে পরিমাণ মানুষ আসেন এবং তাদের যে চাহিদা – সেটা দিতে পারেনি৷ ফলে একদিকে চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি৷ সেই কারণেই মূলত আমাদের এই অব্যবস্থাপনা৷ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণটাও ঠিকমতো করতে পারিনি৷ সবকিছু মিলে আমাদের এই শহরটা বসবাসের অনুপযোগী অন্যান্য শহরের মধ্যে একেবারে উপরের দিকে উঠে এসেছে৷
এই তালিকা থেকে ঢাকাকে বের করার কোনো সুযোগ আছে?
এর থেকে বের হওয়ার দু’টি উপায় রয়েছে৷ প্রথমত ঢাকার বাইরে পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও বিনিয়োগে মনোযোগ তৈরি করা৷ বিশেষ করে বিভাগীয় শহর, জেলা শহরসহ দেশে যে ৩২৮টি পৌরসভা আছে, সেখানে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য যে সেবাগুলো আছে, তার ব্যবস্থা করা৷ এই শহরগুলোকে যদি আমরা এভাবে তৈরি করতে পারি, তাহলে ঢাকার উপর যে চাপ, সেটা আপনা-আপনি কমে আসবে৷ এটা একটা পদ্ধতি৷ অন্যটা হলো, এখনো আমরা ঢাকা শহরে অনেক সমস্যা নিয়ে সংগ্রাম করছি৷ সেগুলো চিহ্নিত করে চাহিদার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধানের জন্য বিনিয়োগ করা৷ এই বিনিয়োগটা ঢাকার জন্য যেমন করতে হবে, ঢাকার বাইরের জন্যও করতে হবে৷ তাহলেই ঢাকা শহরের উন্নতিটা করা সম্ভব হবে৷
ঢাকায় যানজটের জন্য জায়গার অভাবকে দায়ী করা হয়৷ এটাই কি মূল কারণ, নাকি সঠিক পরিকল্পনার অভাব?
আমি মনে করি না, এটাই কারণ৷ বিশ্বের আরো অনেক শহর বা মেগাসিটি আছে, যেখানে ঢাকার মতো রাস্তার পরিমাণ কম৷ কম থাকাটা একটা বিষয়, এটা স্বীকার করি৷ তবে এটা একমাত্র কারণ না৷ অন্যান্য মেগাসিটিতে মেট্রো আছে, ট্রেন আছে, আন্ডার গ্রাউন্ড আছে৷ কোথাও কোথাও লাইট ট্রেন আছে৷ মূল কথা হলো, ভালো একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস থাকা৷ অর্থাৎ গণমুখী পরিবহণ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন৷ আমাদের এখানে যে বাসগুলো চলে সেগুলো কিছু প্রাইভেট কোম্পানি দ্বারা বিক্ষিপ্তভাবে চলে৷ এগুলো কোনো সুশৃঙ্খল পরিবহণ ব্যবস্থা নয়৷ এ কারণে আমরা এত বেশি সমস্যার মধ্যে পড়ি৷ আমাদের ভালো পরিকল্পনার অভাব আছে, বাস্তবায়নেরও অভাব আছে৷ আমাদের ‘রিভাইস স্ট্র্যাটেজি রিভাইস প্ল্যান’ নামে একটি পরিকল্পনা আছে, সেখানেও ভালো কিছু পরিকল্পনা দেয়া আছে৷ সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমাদের পরিবহণ ব্যবস্থার আরো উন্নতি হবে৷
অপরিকল্পিত নগরায়নের সঙ্গে দুর্নীতির কি কোনো সংযোগ আছে?
নিশ্চয়ই আছে৷ যেমন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্ল্যানে যে ধরনের প্রস্তাব দেয়া থাকে, অনেক সময় তার ব্যাত্যয় ঘটে৷ মূলত দুর্নীতির কারণে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার অনেক ব্যাত্যয় ঘটে৷ সেই কারণে আমি বলব যে, দুর্নীতিও একটা কারণ৷
আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কি নগর পরিকল্পনার বাধা হয়ে দাঁড়ায়?
এটা সারা বিশ্বের জন্য৷ বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সরকারি নীতি -নির্ধারকদের চেয়েও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে, তখন সেখানে সমস্যা হয়৷ ঢাকার ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে৷ ঢাকায় যারা আবাসন প্রকল্প করছেন, তাদের অনেক সময় সরকারের পাস করে দেয়া প্ল্যান এড়িয়ে যেতে দেখা যায়৷ এটা মহানগরীর পূর্বাংশে আমরা দেখেছি৷ সেখানে ‘ফাস্ট ফ্লো জোন’ বা নীচু এলাকা ভরাট করে আবাসিক প্রকল্প তৈরি করতে দেখেছি৷ এগুলো তখন হয়, যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী যে সংস্থাগুলো আছে, তার চেয়েও এরা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে৷
রাজধানী ঘিরে পরিকল্পনায় সরকারের আন্তরিকতা কতটুকু?
আমরা যখন কোনো সভা-সেমিনারে বা অনুষ্ঠানে যাই, তখন আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখি না৷ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও আমরা আন্তরিকতা দেখি৷ কিন্তু বাস্তবায়নের জায়গায় তার প্রতিফলনটা আসে না৷ কখনও কখনও আসে, তবে বেশিরভাগ সময়ই তার প্রতিফলন দেখি না৷
রাজধানীকে সুন্দর একটা নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে আপনার পরামর্শ কী?
সমগ্র বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা তৈরি করা এবং সেখানে সারাদেশে যে জনসংখ্যার বিন্যাশ, সেটা চিন্তা করা ও দেশের ভেতরে যে প্রকৃতিক সম্পদ আছে, যেমন বনভূমি, জলাভূমি, কৃষি এলাকা এবং নগরের এলাকা, সেগুলোকে নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা৷ এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা৷ আরেকটি বিষয় হলো, যে শহরের জন্যই আমরা যে পরিকল্পনা করি না কেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যেন সেই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হয়৷ এটা করা গেলে সারাদেশেই দৃশ্যমান একটা পরিবর্তন আসবে, বিশেষ করে নগরায়নের ক্ষেত্রে৷
আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷