টিভিতে নানের ভূমিকায় অভিনয় করে পরিচিতি পাওয়া এক অভিনেত্রীকে জরিমানা করেছে এক জার্মান আদালত৷ ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ অফিসারদের সামনে নগ্ন হওয়াই তাঁর অপরাধ৷ এই মামলায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে এ বিষয়ক জার্মান আইন৷
বিজ্ঞাপন
আন্টিয়ে ম্যোনিং উম হিমেলে ভিলেন (স্বর্গের দোহাই) নামের জনপ্রিয় জার্মান টিভি শো-তে স্ট্রিপার থেকে নানে পরিণত হওয়া এক চরিত্রে অভিনয় করেন৷ অনেক সাক্ষাৎকারেই একাধিকবার তিনি বলেছেন, নগ্ন হতে তাঁর ভালো লাগে৷
২০১৮ সালের জুনে বাভারিয়ার গ্রামীণ এলাকার এক পার্কিং এরিয়ায় তিন ব্যক্তির সামনে তিনি নগ্ন হন৷ স্বচ্ছ কাপড় পরা ম্যোনিং এক পর্যায়ে তাঁর স্কার্ট তুলে গোপনাঙ্গ প্রদর্শন করেন৷ এ সময় তাঁর পরনে কোনো অন্তর্বাসও ছিল না৷
তবে ম্যোনিং জানতেন না, তিন ব্যক্তির একজন ট্রাকচালক হলেও বাকি দুজন ছিলেন ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা৷ তাঁদের একজন গোপনে পুরো ঘটনা ভিডিও করেন এবং ম্যোনিং-এর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনেন৷
আদালত অশ্লীলতার অভিযোগ খারিজ করে দিলেও অভব্য আচরণের দায়ে ম্যোনিংকে ৩০০ ইউরো (প্রায় ৩০ হাজার টাকা) জরিমানা করেছে৷
রায়ের পর ম্যোনিং বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না নারী হিসেবে শরীর প্রদর্শন করাও একটা অপরাধ৷''
আইনে অস্পষ্টতা
জার্মান পেনাল কোডের ১৮৩ এ অনুযায়ী, অশ্লীল ব্যবহার একটি অপরাধ৷ এর সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, ‘প্রকাশ্যে যৌন আচরণ এবং এর মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আঘাত করা'৷ অপরাধের সাজা জরিমানা এবং এক বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে৷
আইনজীবী স্টেফেন লিন্ডবার্গ বলেন, ‘‘আইনে কোনটা অশ্লীল আচরণ আর কোনটা নয়, তা নির্ধারণ খুবই বিতর্কের বিষয়৷ প্রকাশ্যে চুমু খেলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না৷ এমনকি বুন্ডেসলিগার ম্যাচ চলাকালে কেউ নগ্ন হয়ে মাঠে ঢুকে পড়লেও তাঁর বিরুদ্ধে এই আইনে অভিযোগ দায়ের করা হয় না৷''
এর ফলে ম্যোনিংয়ের ক্ষেত্রে কিসের ভিত্তিতে এই অভিযোগ দায়ের হলো এমন প্রশ্ন উঠেছে৷ প্রকাশ্যে গোপনাঙ্গ প্রদর্শন রুখতে সাধারণত কাজে লাগানো হয় ১৮৩ ধারা৷ কিন্তু সে আইন ম্যোনিংয়ের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারেনি পুলিশ, কারণ, সে ধারায় শুধু পুরুষদের কথাই বলা হয়েছে৷
জার্মানিতে নগ্নতাবাদ
অন্য অনেক দেশের তুলনায় জার্মানির সৈকতে বা স্টিম বাথগুলোতে ‘নগ্নতাবাদ’ অনেক সহনীয় একটি ব্যাপার৷ ছবিঘরে থাকছে জার্মানির ‘নুডিজম’ বা নগ্নতাবাদের ইতিহাস...
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Pedersen
‘মুক্ত দেহ’
ফ্রাইকরপারকুলটুর (সংক্ষেপে এফকেকে) বা নগ্নতাবাদ জার্মানির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অন্যতম৷ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অবশ্য ‘ফ্রি বডি কালচার’-এর এই ঝোঁক কমে আসছে৷ তবে সৈকতে, স্পা সেন্টারে, এমনকি পার্কেও নগ্নতাবাদের এই ঐতিহ্য পালন করেন অনেকেই৷
ছবি: Imago/D. Matthes
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
১৯ শতকের শেষের দিকে জার্মানদের প্রবল বিশ্বাস ছিল, কাপড় ছাড়া থাকা এবং নগ্ন হয়ে লেকে গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷ সেইসময়ে জার্মানদের মধ্যে দূষিত শিল্প এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত প্রাকৃতিক এলাকায় বসবাসেরও একটা প্রবণতা দেখা দেয়৷ নগ্ন হয়ে ব্যায়াম বা পাহাড়ে ওঠার মাত্রাও ছিল বেশি৷ দুই নারীর এই ছবিটি ১৯৩৩ সালে বাভারিয়ার কিমজি লেক থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/IMAGNO/Christ
চলচ্চিত্রে নগ্নতাবাদ
‘ভেগে সু ক্রাফট উন্ড শ্যোহাইট’, বাংলায় ‘সামর্থ্যবান ও সুন্দর থাকার পথ’ নামের একটি জার্মান ছবিতে সেই ১৯২৫ সালেই নগ্নতাবাদের ব্যাপারটি প্রথম তুলে ধরা হয়৷ বিখ্যাত জার্মান পরিচালক ও অভিনেত্রী লেনি রিফেনস্টালের এই সিনেমাটি নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা৷ এরমধ্যে নগ্ন হয়ে গোসল ও নাচের দৃশ্য ছিল প্রচুর৷
ছবি: Imago
এফকেকে এবং নাৎসী বাহিনী
পরিচালক ও অভিনেত্রী লেনি রিফেনস্টাল পরে হিটলারের প্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালকে পরিণত হন৷ ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক নিয়ে পরিচালিত সিনেমা ‘অলিম্পিয়া’য় নগ্নতাবাদের মধ্য দিয়ে তিনি ‘আর্য দৈহিক গঠন’-এর খেলার বিচারিক মানদণ্ডের সংযোগ কী, সে সংক্রান্ত একটি বিতর্কিত ও জাতিবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেন৷ হিটলারের নাৎসী পার্টি ক্ষমতায় আসার পরপরই নগ্নতাবাদ নিষিদ্ধ করলেও আবার তা অনুমোদন দেয় ১৯৪২ সালে৷
ছবি: Criterion
পূর্ব জার্মানিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা
মূলত সংস্কৃতি কর্মীদের হাত ধরে ১৯৫০-এর দশকে পূর্ব জার্মানিতে নগ্নতাবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ ধারা চলে৷ তথাকথিত কমিউনিস্ট শাসনের আওতায় থাকা পূর্ব জার্মানির জনগণের জীবনযাত্রা অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল৷ নগ্নতাবাদ ছিল সেখানে মানুষের একমাত্র ছাড়ের অংশ৷ ছবিটি ১৯৮৪ সালে পূর্ব বালিনের মুগিজি লেকের পাড় থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Uhlema
বাল্টিক সাগড় পাড়ে
বাল্টিক সাগর পাড়ের সৈকতগুলোতে নগ্নতাবাদ খুব স্বাভাবিক৷ তবে পোল্যান্ডের সীমানায় এটি দেখা যেতো না৷ পোল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার পর এক দেশের নাগরিক অন্যদেশে গেলেও পোল্যান্ড এবং জার্মানির মধ্যে নগ্নতা নিয়ে যথেষ্ট উত্তেজনা দেখা দেয়৷
ছবি: Imago/argum/C. Lehsten
নগ্নতাবাদের মূল দর্শন
ছবিটি ১৯৮০ সালে লাইপসিশের একটি সৈকত থেকে তোলা৷ যৌনতা নয়, নগ্নতাবাদের মূল দর্শন হলো, নিজের আত্মাকে উন্মুক্ত করে দেওয়া– সামাজিক সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত করার চর্চা করা৷ প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার এই মতবাদে যৎসামান্য সাঁতারের পোশাক পরাকেই নিরুৎসাহিত করা হয়৷
ছবি: Imago/imagebroker
মিউনিখেও রয়েছে নগ্নতাবাদ চর্চা
খালি পূর্ব জার্মানিতে নয়, মিউনিখেও রয়েছে নগ্নতাবাদের চর্চা৷ তবে জনসমক্ষে নগ্ন হওয়া মিউনিখে নিষেধ৷ কিন্তু কিছু অনুমোদনপ্রাপ্ত এলাকা, যেমন ‘ইংলিশ গার্টেন’ এবং ইজার নদীর তীর কিংবা ফ্লাউখার সৈকতে নগ্নতাবাদের সর্বোচ্চ চর্চা হয়৷ ছবিটি ২০০২ সালের একটি গরমের দিনে তোলা৷ এফকেকে এলাকাগুলোতে নির্দিষ্ট চিহ্ন দেওয়া থাকে এবং সেখানে নগ্ন হয়ে থাকা মানুষগুলো কোনওভাবেই পর্যটক আকর্ষণ করতে চান না৷
ছবি: Imago/K-P. Wolf
বার্লিনের পার্কে
প্রকাশ্যে নগ্নতা বার্লিনে নিষিদ্ধ৷ তবে কিছু কিছু পার্ক, যেমন মাওয়ার পার্ক, ভল্কসপার্ক ফ্রিডরিশাইন এবং টিয়ারগার্টেনে তা অনুমোদিত৷
লাখ লাখ জার্মানের পছন্দ
ছবি: Imago/Lem
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নগ্নতাবাদ
কথিত আছে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বার্লিন দেয়াল পতনের দিন স্টিম বাথ বা সাউনা নিয়েছেন৷ তবে প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি সাউনায় যেতেন৷ পরিসংখ্যান বলছে, ৩ কোটি জার্মান দেশটির ২ হাজার ৩০০ সাউনায় যেতেন প্রতিনিয়ত৷ প্রায় সব স্টিম বাথের জায়গায় নারী-পুরুষ একসাথেই প্রবেশ করতে পারেন এবং সেখানে তাদের বস্ত্রহীনই থাকতে হয়৷ তবে যৌন ব্যবসার স্থান বা পতিতালয়ের সাথে এসবকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleul
বুনো এবং উদাম
সবাই না হলেও কেউ কেউ নগ্ন হয়ে পাহাড়ে ওঠেন৷ উত্তর জার্মানির হার্জ পাহাড়ে এরকম আঠারো কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, যেখানে নগ্ন হয়ে উঠতে হবে আপনার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
পেনাল কোডের এই ধারায় বলা আছে, ‘‘প্রদর্শনের মাধ্যমে একজন পুরুষ অন্য কাউকে হয়রানি করলে তাঁকে জরিমানা বা এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হবে৷''
লিন্ডবার্গ বলছেন, ‘‘আমার ধারণা, তিনি (ম্যোনিং) পেনাল কোড ১৮৩ আর ১৮৩ এ-র গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছেন৷ তিনি সামান্য স্কার্ট তুলেছেন আর একটু শরীর দুলিয়েছেন৷ কোনো যৌন আচরণ না করায় এটা অশ্লীল নয়৷ বরং প্রদর্শন করার অন্য ধারাটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যেতো, কিন্তু সেটি শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷''
এই দুই ধারাকেই ‘ত্রুটিপূর্ণ' বলে উল্লেখ করেন লিন্ডবার্গ৷ লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে এমন আইনকে তিনি ‘হাস্যকর' বলেও অভিহিত করেন৷
তিনি বলেন, ‘‘আজ অথবা কাল, আইনের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এই দুই ধারা৷ শিগগিরই এমন প্রশ্নও উঠবে, যাঁরা নারী বা পুরুষ কোনোটাই নন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই আইন কিভাবে প্রযোজ্য হবে৷''