ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে ইউরোপের ২৮টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক লেখনিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে একগুচ্ছ সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ব্রেক্সিট ছাড়াও ঘরে-বাইরে অনেক সংকটের মুখে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ আগামী মে মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে৷ বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনমোহিনী ‘পপুলিস্ট' রাজনৈতিক দলগুলি জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি একাধিক বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরে মানুষের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তাদের মধ্যে অনেক শক্তি ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধেও সরব৷ এমন চ্যালেঞ্জের মুখে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ইউরোপের নাগরিকদের কাছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর স্বপ্নের রূপরেখা তুলে ধরলেন৷ ইইউ সদস্য দেশগুলির ২৮টি সংবাদপত্রে তাঁর লেখা সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় নাগরিকদের মনে ইইউ-র প্রতি আরও আস্থা, ভালবাসা ও উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে চান৷ সুদূরপ্রসারী সংস্কারের মাধ্যমে তিনি তাঁদের অনেক ক্ষোভ দূর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন৷ তাঁর মতে, আধুনিক বিশ্বের অনেক ঘটনার ফলে ইউরোপের মানুষ ধাক্কা খাচ্ছেন৷ অথচ ইইউ সে সব থেকে তাঁদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ এই সংকটের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ব্রেক্সিট৷ মাক্রোঁ মনে করেন, জাতীয়তাবাদীরা মানুষের সেই ন্যায্য ক্ষোভের ফায়দা তুলছে, যদিও তাদের ঝুলিতে কোনো সমাধানসূত্র নেই৷ তাই তাদের মোকাবিলা করতে হবে৷
এমানুয়েল মাক্রোঁ মনে করেন, একমাত্র ইউরোপীয় স্তরেই বর্তমান সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করা সম্ভব৷ সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ তবে তার জন্য ইইউ-র বর্তমান কাঠামো উপযুক্ত নয়৷ অর্থাৎ যেমনটা চলে আসছে, সবকিছু সে ভাবে রেখে দিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না৷
বর্তমান জগতে গণতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কেও সাবধান করে দিয়েছেন মাক্রোঁ৷ বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর যেভাবে সাইবার হামলা ও অবৈধ হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে, তার মোকাবিলা করতে তিনি গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য এক ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব রেখেছেন৷ তাছাড়া ইউরোপের রাজনৈতিক দলগুলির জন্য বাইরে থেকে অর্থের জোগান নিষিদ্ধ করতে চান তিনি৷ নির্বাচনি প্রচারের সময়ে ভুয়া তথ্য ও খবর ছড়ানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে ফ্রান্স গত বছর যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে, ইউরোপীয় স্তরেও তেমন পদক্ষেপ দেখতে চান তিনি৷
অভিবাসন সম্পর্কে ইউরোপের মানুষের ভয়ভীতি দূর করতেও মাক্রোঁ কিছু প্রস্তাব রেখেছেন৷ শেঙেন এলাকার সংস্কার ও ইউরোপের বহির্সীমানার জন্য ইউরোপীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এক ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান দেখতে চান তিনি৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন, সুরক্ষিত সীমানা ছাড়া কোনো সমাজের মধ্যে আত্মপরিচয় বোধ সম্ভব নয়৷
এমানুয়েল মাক্রোঁ ইউরোপীয় স্তরে প্রতিরক্ষার কাঠামো আরও জোরদার করতে চান৷ তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য জগতের জন্যও ইউরোপের স্বার্থে তিনি কিছু সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছেন৷
কীভাবে বড় হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন
১৯৫৭ সালে পশ্চিম ইউরোপের ছয় দেশ নিয়ে শুরু হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ এরপর থেকে এর পরিসর বেড়ে এখন ২৮টি দেশ এর সদস্য৷ বিগত বছরগুলোতে এই জোটের পরিসর কীভাবে পরিবর্তিত হলো তা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Diezins
১৯৫৭: ছয় দেশের নতুন ইউরোপ
রোম চুক্তি সই করার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ জোট বাধে জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবুর্গ৷ সমন্বিতভাবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যে সুবিধা নেয়াই ছিল ইউরোপীয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি বা ইইসি নামের এই জোটের লক্ষ্য৷ ইইসি ও অন্য জোটগুলো মিলে কয়লা, ইস্পাত ও পরমাণু সহযোগিতায় একসঙ্গে কাজ শুরু করলে এর নাম হয় ইউরোপীয়ান কমিউনিটিস বা ইসি৷
ছবি: picture-alliance/AP Images
১৯৭৩: ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্ক
যুক্তরাজ্য শুরুতে গররাজি থাকলেও ষাট এর দশকে এসে যোগ দেয়৷ ফ্রেঞ্চদের বিরোধিতার কারণে প্রথম দু’বার তাদের যোগ দেয়ার প্রচেষ্টা সফল হয়নি৷ পরে অবশ্য প্যারিস তাদের আপত্তি তুলে নেয় এবং আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্কের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে ইসি-তে যোগ দেয় যুক্তরাজ্য৷ তবে সেজন্য ১৯৭৫ সালে নিজ দেশে একটি গণভোটেরও আয়োজন করতে হয় ব্রিটিশদের, যেখানে সিংহভাগ মানুষ এর পক্ষে ভোট দেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Lipchitz
১৯৮১: গ্রিস
ছয় বছর চেষ্টার পর ১৯৮১ সালে দশম সদস্য হিসেবে ইসি-তে যোগ দেয় গ্রিস৷ ১৯৭৪ সালে ভূমধ্যসাগরের দেশটিতে সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ও গণতন্ত্রের পুনর্বহালের সময় চলমান টানাপোড়েন জোটে যোগ দেয়ার বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করে৷ এমনকি এই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশটির জোটভুক্ত হওয়া নিয়ে মতভিন্নতা ছিল অন্য দেশগুলোর মধ্যে৷
ছবি: Getty Images/C. Furlong
১৯৮৬: স্পেন ও পর্তুগাল
পাঁচ বছর পর জোটভুক্ত হয় স্পেন ও পর্তুগাল৷ গ্রিসের মতো তারাও ছিল নতুন গণতন্ত্রের দেশ৷ স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো মারা যান ১৯৭৫ সালে৷ সে বছর পর্তুগালেও স্বৈরশাসক সরকারের পতনের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবি: picture-alliance/G. Silva
১৯৯৫: অস্ট্রিয়া, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড
ইসি আজকের দিনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে পরিণত হয় ১৯৯২ সালে মাস্ট্রিক্ট চুক্তি অনুযায়ী৷ ১৯৯৫ সালে নতুন রূপের এই জোটে যোগ দেয় অস্ট্রিয়া, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড৷ শীতল যুদ্ধের সময় এই তিন দেশই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে৷ ফলে নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো জোটভুক্ত হয়নি তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Bry
২০০৪: পূর্ব ইউরোপের দশ দেশ
২০০৪ সালের ১ মে ইইউ-তে সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণের ঘটনা ঘটে৷ চেক রিপাবলিক, এস্তোনিয়া, সাইপ্রাস, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, হাঙ্গেরি, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া যুক্ত হয়৷ এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য এটি একটি বিরাট উদ্যোগ ছিল৷ দুই দশক আগেও এই দেশগুলোতে কমিউনিজম ছিল৷ সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদি রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে এই উদ্যোগ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০৭: রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া
২০০৪ সালেই রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া জোটভুক্ত হতে চেয়েছিল৷ কিন্তু জোট থেকে দেশ দু’টির বিচার বিভাগ ও রাজনীতিতে যে সংস্কারের শর্ত দেয়া হয়েছিল, তা পূর্ণ করতে দেরি হওয়ায় তাদের জোটভুক্তির প্রক্রিয়াও দেরি হয়৷ এই ব্লকের সবচেয়ে গরিব ও দুর্নীতিপরায়ণ দেশ এরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Donev
২০১৩: ক্রোয়েশিয়া
সবশেষ জোটভুক্ত দেশ ক্রোয়েশিয়া৷ স্লোভেনিয়ার পর রক্তক্ষয় করে যুগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে আসা দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ইইউ-তে যোগ দেয় তারা৷ যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছেদ হওয়া আরো দু’টি দেশ মন্টেনেগ্রো ও সার্বিয়া ২০১২ ও ২০১৪ সাল থেকে জোটে যোগ দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/D. Puklavec
ভবিষ্যত: মেসিডোনিয়া ও আলবেনিয়া
২০১৮ সালের জুনে ইইউ সিদ্ধান্ত নেয় যে, আরো দু’টি বলকান দেশ, মেসিডোনিয়া ও আলবেনিয়াকে যুক্ত করার বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করা যেতে পারে৷ তবে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনা ও কসভোর মতো অন্য যুগোস্লাভ দেশগুলোর বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷