নতুন করে ভাবতে হবে
২৪ জুলাই ২০১৮ডয়চে ভেলে প্রতিবছর গ্রীষ্মে সামার ফেস্টিভালের আয়োজন করে৷ সেখানে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সবাই একত্রিত হন৷ চলে খাওয়া দাওয়া, নাচ গান৷ এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ বনের পাশে বড় শহর কোলনে এবারের আয়োজনে যোগ দেবার সুযোগ হয়েছিল আমারও৷
সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড়ে কালো পোশাক পরা কিছুটা চঞ্চল এক জার্মান যুবক দৃষ্টি কাড়লেন আমার৷ পেটানো শরীর, পরিষ্কার ভাঁজ কাপড়ে৷ খুব পরিপাটি করে জেল দেয়া চুলগুলো মিহি করে কাটা৷
বুঝতেই পারছিলাম, তিনি ডয়চে ভেলের কেউ নন৷ এক ফাঁকে আলাপও হলো৷ তিনি নিরাপত্তার সেবা দেয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা৷ এখানেও এই অনুষ্ঠানটির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে তাঁর প্রতিষ্ঠান৷
আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুব আগ্রহ দেখালেন তিনি৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের দেশে কি যুদ্ধ চলে?''
আমি আকাশ থেকে পড়লাম ও পড়ে ব্যথাও পেলাম৷ বললাম, ‘‘না তো৷ কেন?'' বললেন, ‘‘তাহলে তোমার দেশ থেকে এত লোক ইউরোপে শরণার্থী হিসেবে আসে কেন?''
যুবক জানালেন যে, তাঁর প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে৷ কোলনের কয়েকটি ক্যাম্পের উদাহরণ দিয়ে বললেন, এসব জায়গায় ২০ ভাগেরও বেশি বাংলাদেশি৷ এর চেয়ে বেশি বোধ হয় আফ্রিকার কোনো একটি দেশ থেকে এসেছে৷
কথায় কথায় তাঁর মনোভাব পরিষ্কার হলো আমার কাছে৷ তিনি বলতে চাইছেন যে, এই শরণার্থীর ঢল, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় সংকটের ফলে এখানকার সংকট তীব্র হচ্ছে৷ তিনি অবশ্য তাঁর সরকারকেও দুষছেন, কারণ, এ নিয়ে কথা বলা যাবে না৷
প্রশ্ন করলাম, ‘‘কী ধরনের সংকট হচ্ছে বলে তোমার মনে হয়?'' ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যা বললেন তার মোদ্দা কথা হলো, ‘‘এরা এসে সমান্তরাল সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে৷ এটাই সংকট৷''
অর্থাৎ, জার্মান মূল্যবোধ, জার্মান সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমান্তরাল আরেকটি সমাজ তৈরি করছে ভিন্ন সমাজব্যবস্থা থেকে আসা অনেক নতুন মানুষ৷ অনেক সমস্যার মধ্যে এটাকেই বড় করে দেখছেন তিনি৷ শুধু তিনি নন, তাঁর মতে বেশিরভাগ জার্মানই এমন মানসিক ও সামাজিক সংকটে ভুগছে৷
বোঝা গেল যে তাঁর মতে, এই জার্মান সমাজের মূল সংকট জাতীয়তাবাদের, সংকট আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের৷ আর যেহেতু শরণার্থী বিষয়ে সরকারের মনোভাব কঠোর নয়, বরং তাদের প্রতি ন্যাটিভরা যেন অন্যায় না করে সে ব্যাপারে কঠোর, তাই নিজেদের নিপীড়িত ভাবছেন অনেক জার্মান৷
একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে৷ লিখেছিলেন চল্লিশের দশকে প্রয়াত সাংবাদিক ও লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং৷ প্রথম তিনটি লাইন বাংলা করলে যা দাঁড়ায়:
আমার প্রবেশদ্বারে তিনি আগন্তুক
হতে পারেন সৎ কিংবা সদয়
কিন্তু তিনি বলেন না আমার ভাষা – আমি বুঝি না তাঁর মন...
ভারতে জন্ম নেয়া ইংলিশ সাংবাদিক রুডইয়ার্ড কিপলিং বিশেষভাবে পরিচিত তাঁর বিখ্যাত ‘জাঙ্গল বুক' বইয়ের জন্য৷
তাঁর এই কবিতাটি ‘ভিন্নদের' প্রতি কোনো গোষ্ঠীর সাধারণ মনোভাবের একটি যথার্থ প্রতিফলন৷ এই মনোভাব এক প্রকারের জাতীয়তাবাদের বোধ থেকে নির্মিত হতে পারে৷
এক প্রকারের বলছি এই কারণে যে, জাতীয়তাবাদের নানান ধরন আছে৷ সাধারণভাবে এই বোধ বা মানসিক অবস্থাটি রাষ্ট্রীয় অথবা রাষ্ট্রীয় নয় এমন জনপ্রিয় ধারণা থেকে উন্মেষ হতে পারে৷
মার্কিন দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ হান্স কোহন তাঁর ‘দ্য আইডিয়া অফ ন্যাশনালিজম' বইয়ের ২০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, সতেরো শ' শতক এমনকি আঠারো শ' শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইউরোপে প্রাক-জাতীয়তাবাদের যুগ ছিল৷ কিন্তু রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণার প্রভাব বৃদ্ধি, রাজনৈতিক জীবনের অসাম্প্রদায়িকীকরণ, মানুষের একক ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধের জাগরণ, প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার বাইরে গিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি ও অগ্রগতি–এসবই জাতীয়তাবাদের উন্মেষের বীজ৷ আর এই দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ হয়, প্রাক্তন ইসরায়েল ও গ্রিস থেকে শুরু করে রোম, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ ও পরবর্তীতে ইউরোপের সংস্কারের পথ ধরে৷
কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানীর মতে, জাতীয়তাবাদ পাঁচটি রূপ ধারণ করতে পারে৷ সেগুলো হলো, গোষ্ঠীগত, ধর্মীয়, সামাজিক অধিকারমূলক, সাংস্কৃতিক অথবা আদর্শগত৷
যেমন, কোনো জাতি যদি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর আচার, ব্যবহার, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে, তাহলে সেখানে যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়, তাকে বলা হয় গোষ্ঠীগত জাতীয়বাদ৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই ধারণার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷
কিংবা কোনো রাষ্ট্রে যদি একটি নির্দিষ্ট ধর্ম সেখানকার রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় নীতিকে নিয়ন্ত্রণ বা বড় দাগে প্রভাবিত করে, তাহলে সেখানে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে বলা যায়৷ সেক্ষেত্রে ইরান বা পাকিস্তানের উদাহরণ টানা যায়৷ কিংবা ভারতে বিজেপি যদি হিন্দুত্ববাদকে আরো প্রভাবশালী করে তুলতে সমর্থ হয়, তাহলেই সেদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি বলা যাবে৷ বাংলাদেশেও ইসলামী জাতীয়তাবাদের এক রকমের বিকাশ ঘটেছে বা ঘটছে৷
সিভিক ন্যাশনালিজম হলো, ভিন্নদের প্রতি সহনশীলতা ও সবাইকে নিয়ে, সবার সামাজিক অধিকারকে গুরুত্ব দেয়ার যে দর্শন, তাকে কেন্ত্র করে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ৷ এমন একটি রাষ্ট্রের মোক্ষম উদাহরণ হলো সিঙ্গাপুর৷ সে দেশে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ধারণাই গড়ে উঠেছে বৈশ্বিকীকরণ ও সিভিক ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে৷ জাতীয়বাদের এই ধারণাকে ভিত্তি করেই বৈশ্বিকীকরণের দর্শন পরিচালিত৷
আদর্শগত জাতীয়তাবাদের ধারণাটি জাতীয়তাবাদের ধারণার উন্মেষের শুরুর দিককার৷ এর অর্থ হলো, রাষ্ট্র আত্মনিয়ন্ত্রিত বা স্বনির্ভর হবে৷ এখানে সীমানা, জনসংখ্যা ও স্বশাসন খুব গুরুত্বপূর্ণ৷
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, জাতীয়তাবাদের প্রতিটি ধারণা যেমন একটির থেকে আলাদা, আবার একটির সঙ্গে আরেকটির কোথাও কোথাও মিলও আছে৷ কেউ কেউ বলেন, একে আরো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়৷ যেমন, অনেকেই বর্ণবাদকে জাতীয়তাবাদের থেকে আলাদা করার বিরোধিতা করেন৷ তাঁদের মতে, সাদা চামড়ার আধিপত্য বজায় রাখার যে দর্শন, তাকেও জাতীয়বাদের কোনো-না- কোনো তকমায় ফেলতে হবে৷
আবার কোনো কোনো জাতীয়বাদের ধারণায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক ঐক্য ও সমতা বিধানের যে বামপন্থি দর্শন, তাকেও ফেলা হয়৷
সময়ে সময়ে রাষ্ট্রের বা সমাজের বা তার অর্থনীতির প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়েছে জাতীয়বাদের ধরন বা ধারণা৷ কিন্তু মূল বোধ কিন্তু একই জায়গায় রয়ে গেছে৷ এর ইতিবাচকতা যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি দেখেছি তা কীভাবে বিভেদ তৈরি করে, এমনকি যুদ্ধও বাধিয়ে দেয়৷ এমনকি কোথাও কোথাও ফ্যাসিজমকেও উস্কে দেয়৷
ঠিক যে সময়টায় আমি লিখছি, সে সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র চলছে সংকট৷ বাণিজ্য আজ জাতীয়বাদের মোড়কে৷ এই মোড়কের আচ্ছাদনে ঘেরা বাণিজ্য বা পুঁজিবাদী চেতনা আজ আমাদের সবার স্বাভাবিক চেতনা গ্রাস করে নিচ্ছে নিয়ত৷ আমরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি৷ আমরা দ্রুত সিদ্ধান্তে এসে পড়ছি৷
এ থেকে বের কিন্তু হতেই হবে৷
আপনিও কি মনে করেন জাতীয়বাদ বিষয়ে সংকটে আছে বিশ্ব? লিখুন নীচের ঘরে৷