নতুন একটি নির্বাচন বাংলাদেশে পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সাংসদ ইওসেফ ভাইডেনহলৎসার৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে এসে ডয়চে ভেলেকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গত ১৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফর করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাবকমিটি৷ এই কমিটি শুধু সরকার নয়, বিরোধী দলের সঙ্গেও আলোচনা করেছে৷
বাংলাদেশ সফরের সময় ঐ সাবকমিটিতে ছিলেন অস্ট্রিয়ার এমপি ইওসেফ ভাইডেনহলৎসার৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে সমঝোতা থেকে বহু দূরে রয়েছে৷ তবে সঠিক পথে যাওয়ার মতো অবস্থায় এখনো রয়েছে দেশটি৷
ডিডাব্লিউ: বাংলাদেশ সফর করে সেখানকার পরিস্থিতি কেমন মনে হলো আপনার?
ইওসেফ ভাইডেনহলৎসার: রাজপথে সংঘর্ষের খুব একটা প্রমাণ নেই৷ কিন্তু আপনি যদি ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন – সরকারের প্রতিনিধি থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত – তখন সংঘাতের গভীরতাটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবেন৷
উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর যে কেউ বুঝতে পারবে যে, দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের কোনো একক রেখা নেই৷ নেই দু' পক্ষের মধ্যে সমন্বয়সাধনের পথ, কেননা কোনোপক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়৷ সরকার এবং বিরোধীপক্ষ উভয়েই আমাদের ভিডিও দেখিয়েছে, যেগুলোতে প্রাণঘাতি হামলার জন্য তারা একে অপরকে দায়ী করেছে৷ পরিস্থিতি অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক বলে মনে হচ্ছে এবং এতে আমি সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন৷
বর্তমান পরিস্থিতি শীঘ্রই ভালো হওয়ার কোনো ইঙ্গিত কি দেখা যাচ্ছে?
অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকগুলি ইতিবাচক দিক দেখতে পাই৷ অর্থনীতি ভালোভাবে চলছে৷ এছাড়া সেদেশে সংঘটিত দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়েও দেশটির মানুষের সচেতনতা বাড়ছে৷ সব মিলিয়ে ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হওয়ার মতো বেশ কয়েকটি ভালো দিক দেশটির রয়েছে৷
তবে প্রতিষ্ঠিত অভিজাত শ্রেণি এই উন্নয়নের পথে এক ধরনের অন্তরায়৷ আমার মনে হয়, দেশটির শীর্ষ দুই নেত্রী বর্তমান বিসংগত পরিস্থিতি বা অচলায়তনের জন্য দায়ী৷
রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক উদ্যোগ তাহলে কীভাবে নেয়া যেতে পারে?
দেশটির প্রগতির জন্য আসলে একটি ‘কমপ্রিহেনসিভ কনসেপ্ট' বা ‘সমন্বিত পরিকল্পনা' প্রয়োজন৷ এ জন্য একটি সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যা জনগণকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেবে৷ আর একমাত্র সেটা করা হলেই বাংলাদেশ খুব তাড়াতাড়ি এই চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস৷
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে আলোচনার সময় উভয়পক্ষই ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্নের উত্তরের বদলে শুধু অতীতের বিভিন্ন ঘটনা টেনে এনেছে৷ আমার মনে হয়, গোটা রাজনৈতিক পরিকাঠামো এই দুই বড় নেত্রীর জন্য ভুগছে, যাঁরা কিনা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যেই নিজেদের আটকে রেখেছেন৷ এ জন্য একটা নতুন নির্বাচন বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে তা রাজনীতিতে কিছু নতুন মুখ এবং নতুন মানুষ নিয়ে আসতে পারে৷ শুধুমাত্র তখনই পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে হয়৷
বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্ভাব্য সমঝোতাকারী হিসেবে আজকাল ইউরোপের নাম উঠে আসছে৷ ইইউ কি সেজন্য প্রস্তুত?
বাংলাদেশের কিন্তু মধ্যস্থতাকারীর তেমন একটা দরকার নেই৷ তবে আমার মনে হয়, দেশটির বিদেশ থেকে চাপ প্রয়োজন৷ সেটা না হলে কাজ হবে না৷ আর এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এই অঞ্চল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী৷
তাছাড়া সংঘাত পরিহার বা নিরসনে ইউরোপের একটা ঐতিহ্য রয়েছে৷ সেটা বিবেচনায় নিলে দু'পক্ষের মধ্যে সমঝোতা-সংলাপে আমরা যথার্থ মধ্যস্থতা করতে পারি৷ তবে উদ্যোগটি অবশ্যই বাংলাদেশের তরফ থেকে আসতে হবে৷
ইওসেফ ভাইডেনহলৎসার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির একজন সদস্য৷
অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত জনজীবন
বাংলাদেশে টানা অবরোধ ও হরতালের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা৷ ক্রেতার অভাবে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে৷ শুধু অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মুষড়ে পড়েছে পরিবহন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুরনো ঢাকার বাবু বাজারে কাগজ বোঝাই একটি ট্রাকে জ্বলছে দুষ্কৃতিকারীদের দেয়া পেট্রোল বোমার আগুন৷ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ৷ ডাকা হচ্ছে হরতালও৷ অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে আলোচিত পেট্রোল বোমা৷ শুধু পেট্রোল বোমার আগুনেই পুড়ে মরেছে কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশ প্রহরায় চলছে পরীক্ষা
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়িাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পুলিশ প্রহরা৷ চলমান এ অবরোধ-হরতালে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা অন্যতম৷ বর্তমানে সারা দেশে চলা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন তাই অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে৷ টানা অবরোধের মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে চলছে পরীক্ষা৷ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূরপাল্লার বাস নেই বললেই চলে
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলির ডাকা অবরোধে বাংলাদেশের প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্ত৷ দুপুর বেলায় তোলা এ ছবিতে মহাসড়কটি প্রায় যানবাহন শূন্য৷ কিন্তু সাধারণ সময়ে এ সড়কটি থাকে যানবাহনে ভরা৷ বাংলাদেশে চলমান অবরোধে দূর পাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে বহুলাংশে৷ একের পর এক পেট্রোল বোমার ঘটনায় ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন না অনেক মালিকই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজিবি-র টহল পর্যাপ্ত নয়
অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয়, মানে ঢাকার বাইরে বিজিবি-র টহল থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য৷ এছাড়া সম্প্রতি রাত ন’টার পরে বাস চলাচলে সকলকে নিরুৎসাহ করার কারণে বাস মালিকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় অস্বাভাবিক নয় যানজট
বাংলাদেশে চলমান এই অবরোধে ঢাকার ভেতরের সড়কের দৃশ্য অবশ্য আলাদা৷ যান চলাচল অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, অনেক জায়গাতেই যানজট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা
ঢাকার ফার্মগেটে অফিস শেষে গাড়ির অপেক্ষায় বাড়িমুখী মানুষের ভিড়৷ টানা অবরোধে গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেহাল হলেও, অর্থাৎ গাড়িঘোড়ার চলাচল কম থাকাতে দুর্ভোগ বেড়েছে অফিসমুখী ও অফিস ফেরত মানুষের৷ অফিসে যেতে বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাধারণ মানুষ তাই পড়ছেন দুর্ভোগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবরোধে নদীপথের ভিন্ন চিত্র
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাটের চিত্র এটি৷ গত একমাসেরও বেশি সময়ের এই অবরোধে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো সহিংসতা ঘটেনি নদীপথে৷ তাই নদীপথে যান চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই আছে৷ ঢাকা থেকে প্রধানত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো
বিএনপি ও সমমনা দলের জোটসমূহের ডাকা হরতাল-অবরোধে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাস স্টেশন গাবতলীর দৃশ্য এটি৷ বেশিরভাগ দূর পাল্লার রুটের বাসই এ স্টেশনে পার্ক করে রাখা৷ হরতাল-অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল অনেকাংশেই বন্ধ আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
খদ্দেরহীন এক রেস্তোরাঁ
ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনের খদ্দেরশূন্য মোহাম্মাদীয়া রেস্তোরাঁ৷ অবরোধের কারণে এ রেস্তোরাঁর লোকবল ১৬ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ বাকি যে আটজন আছেন তাঁদেরও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না মালিক৷ গাবতলী স্টেশন থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল কম থাকায় এ রেস্তোরাঁটি দিনের বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ
অবরোধ আর হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য সড়কে চলাচলকারী বাস আর ট্রাক৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেই যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রাকে৷ এতে কমপক্ষে ৬০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পোড়ায় ক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরো শতাধিক সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কমলাপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষায় যাত্রীরা
অবরোধে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করলেও, সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ৷ বিভিন্ন সময়ে অবরোধকারীদের রেল লাইনের ‘ফিশপ্লেট’ খুলে ফেলার কারণে কয়েকটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে৷ তাই বেশিরভাগ ট্রেনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন৷
ছবি: DW/M. Mamun
খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা
টানা অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা৷ স্বল্প পুঁজির এ সব ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকেরই৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুঁজি ভেঙে চলছে যাঁর সংসার
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার ফুটপাথে কম্বলের ব্যবসা করেন গাজীরুল ইসলাম৷ দুপুরবেলা পর্যন্ত এ দিন তাঁর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭’শ টাকার একটি কম্বল৷ তাও তার কেনা দামের থেকে ৩০০ টাকা কম৷ লাভ তো দূরের কথা সংসার চালাতে এখন পুঁজি টুকুনিই ভরসা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রই যখন ভরসা
ঢাকার নবাবপুর থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ফিরছেন এক গাড়ি চালক ও তাঁর সহকারী৷ টানা অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে নিজেদের গাড়িতে এখন থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখবেন তাঁরা৷