প্রতি বছর একই ব্যাপার৷ বড়দিন ও নববর্ষের মাঝামাঝি কয়টা দিন জার্মানরা নতুন বছর কীভাবে কাটানো যায়, কোন কোন ভাল কাজ করা যায়, তা নিয়ে মাথা ঘামায়৷ তবে অনেকের পক্ষে সেই ইচ্ছা পূরণ সম্ভব হয় না৷
বিজ্ঞাপন
৪০ শতাংশ জার্মান বছরের শেষ প্রান্তে এসে পরের বছরের জন্য একটা পরিকল্পনা করতে চান৷ এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে স্ট্রেস বা চাপ কমানো৷ পরের স্থানে আছে পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও খেলাধুলা৷ ২০১৩ সালের সমাপ্তি লগ্নে জার্মানদের আগামী বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এই তথ্য জানায় ‘ফোরসা ইন্সটিটিউট'৷
বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি৷ স্বাস্থ্য বিমা প্রতিষ্ঠান ডিএকে-এর উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে এই ধরনের সমীক্ষা চালানো হচ্ছে৷ এবার তিন হাজারের বেশি নারী ও পুরুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷
নতুন করে যাত্রা
নতুন বছর অনেকের জন্য নতুন করে যাত্রা শুরু করা, বলে মনে করেন বখুমের মনস্তত্ত্ববিদ ইউর্গেন মারগ্রাফ৷ এর পেছনে রয়েছে তিনটি মনস্তাত্ত্বিক দিক৷ নতুন বছরের পরিকল্পনা হলো জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা৷ ‘‘আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই৷ কারণ আমরা জানি, যে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা আমাদের ক্ষতি করে না৷''
জার্মানিতে বড়দিনের উৎসব পালন
যে-কোনো উৎসব মানেই আনন্দ আর তা সবার জন্যই৷ চলুন এই ছবিঘরের মধ্য দিয়ে জানা যাক কে কিভাবে উৎসবের আনন্দ গ্রহণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিসমাস ট্রি
যে-কোনো উৎসব মানেই হৈচৈ, আনন্দ, উপহার, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া৷ তবে তা যদি হয় ধর্মীয় কোনো উৎসব তাহলে স্বাভাবিকভাবে সবকিছুর মাত্রা খানিকটা বেড়ে যায়৷ জার্মানিতে বড়দিনের উৎসব নানাজনে নানাভাবে উদযাপন করে৷ বেশিরভাগ মানুষই অতি যত্নে ক্রিসমাস ট্রি সাজান৷ আর সবাই অপেক্ষা করে থাকে ক্রিসমাস ট্রির নীচে রাখা উপহারের জন্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আস্ত মাছ ভাজি
যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ২৪ ডিসেম্বর রাতে৷ তাই এ রাতকে পবিত্র রাত বলা হয় অর্থাৎ তখন থেকে বড়দিনের মূল উৎসব শুরু হয়ে যায়৷ জার্মানিতে সেদিন রাতে পুরনো ঐতিহ্য অনুযায়ী মাছ খাওয়া হয়, বিশেষ করে কারফেন মাছ, তবে সব অঞ্চলে নয়৷ আস্ত মাছটি ওভেনে বেক করে পরে কেটে কেটে পরিবেশন করা হয়৷ এবং এ রাতেই উপহারগুলো সুন্দর প্যাকেটে ভরে ক্রিসমাস ট্রির নীচে সাজিয়ে রাখা হয়৷
ছবি: Fotolia/Teressa
রাজহাঁসের রোস্ট
বড়দিন পারিবারিক উৎসব৷ তাই যারা পরিবার থেকে দূরে থাকে তারা উৎসবের দিনগুলো একসাথে উদযাপন করতে চায়৷ খাবারের আয়োজন হয় বেশ ঘটা করে৷ সেদিন খাওয়া হয় বিশাল আকারের ওভেনে রোস্ট করা রাজহাঁস৷ এর জন্য রয়েছে বিশেষ রেসিপি৷ রাজহাঁসের পেটের ভেতরে যে মশলা বা পুর ভরা হয় তার ওপরই নির্ভর করে রাজহাঁসের রোস্টের স্বাদ৷
ছবি: picture-alliance/Tobias Hase
ক্রিসমাসের দ্বিতীয় দিন
আয়োজনের দিক থেকে এই দিনটিও অনেকটা ২৫ তারিখের মতো৷ তবে যাদের পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ কাছাকাছি থাকেন তারা সাধারণত দুদিন দু বাড়িতে যান, অর্থাৎ একদিন মা-বাবার বাড়ি আর পরের দিন শ্বশুর বাড়ি৷ অথবা একদিন নিজেরা যায়, পরের দিন অন্যরা আসে৷ তবে দুদিনই খাবারের আয়োজনে থাকে উৎসবের ছোঁয়া৷ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি প্রচুর মিষ্টি খাবারও থাকে৷ বিশেষ ধরণের কেক, বিস্কুট কত কি!
ছবি: Erika Klein
উপহার
বড়দিন উপলক্ষ্যে প্রিয়জনদের পছন্দের উপহার দেয়ার জন্য আগে থেকে টাকাও জমিয়ে রাখেন৷ জার্মানিতে একটা রীতি বেশ প্রচিলিত, বড়দিন উপলক্ষ্যে কি পেতে চান বা কি প্রয়োজন তেমন একটি তালিকা তৈরি করে রাখেন এবং সেটা দেখেই পরিবারের অন্যরা উপহার কিনে আনেন৷ যদি কারো পছন্দ না হয়, বদল করে আনার সুবিধার্থে কেনার রশিদটিও সাথে দিয়ে দেয়৷ বলা যায়, বাড়ির বাচ্চারা ওদের নানু-দাদুর কাছ থেকে সবচেয়ে দামি উপহারটি পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/chromorange
তরুণ প্রজন্ম
জার্মানরা ঐতিহ্যপ্রিয়, তবে তা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তেমন লক্ষ্য করা যায় না৷ ওরা অনেকেই এতো ঝামেলায় যেতে চায় না৷ তারা ঐতিহ্যবাহী খাবারের চেয়ে হালকা বা সহজ উপায়ে তৈরি খাবারই বেশি পছন্দ করে থাকে৷ যেমন বিদেশি খাবার রাকলেট বা ফনড্যু৷ যা আগে থেকে তৈরি বা প্রস্তুত না করে অতিথি আসার পরে একসাথে বসে ঝটপট করে ফেলা যায় এবং গরম গরম খাওয়া যায়৷
শীতকালীন হলিডে
অনেক জার্মান বড়দিনের ঝামেলায় না যেয়ে চলে যান অন্য কোথায়ও ছুটি কাটাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে৷ জার্মানিতে এখনো তুষারপাত হয়নি৷ কাজেই এবারও ‘সাদা বড়দিন’ হচ্ছে না৷ তাই একসাথে কয়েকদিন ছুটি থাকায় অনেকেই স্কিয়িং করতে চলে যায় সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রিয়ার কোনো পর্বতমালায়৷
ছবি: Fotolia/Gorilla
চলো যাই গরমের দেশে
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বের আবহাওয়ায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন৷ জার্মানি শীতপ্রধান দেশ৷ বছরের এ সময়ে যতটা শীত পড়ার কথা তত শীত না পড়লেও যথেষ্টই শীত৷ গত বছরও ছিলো প্রচণ্ড ঠান্ডা৷ তাই এই শীত থেকে পালাতে অনেকেই বড়দিনের ছুটিতে এমন কোনো দেশে চলে যায় যেখানে হালকা পাতলা পোশাক পরে যথেষ্ট সূর্যের তাপ গ্রহণ করা সম্ভব৷ শীতের বাকি দিনগুলোর জন্য রিজার্ভে রেখে দিতে পারে প্রচুর ভিটামিন ‘ডি’৷
ছবি: picture alliance/dpa
বড়দিনে বিদেশিরা কি করেন?
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো উৎসবই আর শুধু নিজস্ব উৎসব হিসেবে নেই৷ জার্মানিতে ৪০ লাখেরও বেশি মুসলমানের বসবাস৷ তাছাড়া অন্যান্য ধর্মের মানুষও রয়েছেন৷ তারাও ছুটির দিনগুলোতে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলিত হন, খাওয়া-দাওয়া করেন৷ করেন উপহার আদান-প্রদান৷ আসলে ‘ধর্ম যার যার হলেও উৎসব কিন্তু সবার’ – এই রীতিই মানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যায়৷ অনেক বিদেশির বাড়িতেও মোমবাতি বা আলোকসজ্জা দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
কোলনের রাইনগোল্ড মার্কেট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের শ্টেফান গ্রুনেভাল্ডও একই ধারণা পোষণ করেন৷ ভাল কিছু করার পরিকল্পনা আমাদের দিক নির্দেশনা দেয়৷ ‘‘আমি কেমন হতে পারি, তার একটা ছবি মনে আঁকা হয়৷''
দ্বিতীয় একটা দিক হলো অবাস্তব আশাবাদ: ‘‘আমরা আসলে যা পারি তার চেয়ে বেশি পারবো বলে মনে করি,'' ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন মনস্তাত্ত্বিক মারগ্রাফ৷ নতুন বছরের আশা-আকাঙ্খায় আমরা মনে করি, ‘‘আমরা যদি চাই, তাহলেই কিছু করতে পারি৷''
অন্তরে চলে লড়াই
এর ফলে মানুষের অন্তরে একটা লড়াই শুরু হয়ে যায়, বলেন মনস্তাত্ত্বিক গ্রুনেভাল্ড৷ কেউ যদি ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বা খেলাধুলা বাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে, তাহলে অনবরত নিকোটিনের আসক্তি বা মনের ভেতরের ‘দানবটার' বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয়৷
যারা নতুন বছরে কিছু করার অঙ্গীকার করেন, তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক তিন মাসের বেশি সেটা করে যেতে পারেন৷ এই তথ্য জানা যায় ফোরসা ইন্সটিটিউটের সমীক্ষা থেকে৷
আত্মপ্রতারণা
মারগ্রাফ মনে করেন অবাস্তব আশাবাদ থেকেই এই ব্যর্থতা আসে৷ বিশেষজ্ঞ গ্র্যুনেভাল্ড বিষয়টিকে ‘আত্মপ্রতারণা' বলে মনে করেন৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘যেহেতু আমরা আগে থেকেই জানি যে, এই সংকল্প আমরা বাস্তবায়িত করতে পারব না৷''
নতুন বছরের আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দেন এই দুই মনস্তাত্ত্বিক৷ মারগ্রাফ বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে আংশিক পদক্ষেপ কাজে লাগতে পারে৷ বেশি স্পোর্টস করার মানে এই নয় যে ১ জানুয়ারি থেকেই ১০ কিলোমিটার দৌড়াতে হবে৷ তার চেয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনিং দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে৷''
গ্র্যুনেভাল্ড মনে করেন এব্যাপারে মাঝামাঝি একটা লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা উচিত৷ এছাড়া একেবারে অবাস্তব কোনো পরিকল্পনা নেওয়াই ঠিক নয়৷
মনস্তাত্ত্বিকরাও মাথা ঘামান
গ্র্যুনেভাল্ড নিজেও বড়দিন ও নববর্ষের মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করেন, সামনের বছরের কিছু পরিকল্পনা ক্যালেন্ডারে লিখে রাখার জন্য৷ ২০১২ তে একটা বই লেখার কথা ভেবেছিলেন তিনি৷ ‘‘এই কাজটা করতে পেরেছি,'' বলেন এই মনস্তত্ত্ববিদ৷ তবে তাঁর ইন্সটিটিউটে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তাটা বাস্তবায়িত হয়নি৷
ইউর্গেন মারগ্রাফও প্রতি বছরই কিছু না কিছু করার কথা চিন্তা করেন৷ তবে তা একেবারে ১ জানুয়ারি থেকেই নয়৷ জন্মদিন থেকে৷
অনলাইনের একটি পত্রিকা জার্মানদের নতুন বছরের এই উদ্দীপনা সম্পর্কে কৌতুক করে লিখেছে: ‘২০১৪ সালের ১০টি সর্বোত্তম অঙ্গীকার': অর্থহীন জিনিসের জন্য অর্থব্যয় না করা৷ শুধুমাত্র অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ব্যয় করা৷ কিংবা সপ্তাহে একদিন ফিটনেস স্টুডিওতে গিয়ে দেখা ওটি এখনও টিকে আছে কিনা৷