1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নতুন বছরের রাজনীতি

গোলাম মোর্তোজা
১ জানুয়ারি ২০১৮

নতুন বছরের শুরুতে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করা হয়৷ এই রীতি সারা পৃথিবীতেই৷ যা কিছু খারাপ, যা কিছু জটিলতা, তা চলে যাওয়া বছরে রেখে নতুন করে শুরু করতে চাওয়াটাই চিরন্তন৷ যদিও জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সব সময়ই বিস্তর ফারাক থাকে৷

ফাইল ছবিছবি: picture alliance/Landov

বাংলাদেশের মতো দেশে সেই ফারাকটা আরও বেশি পরিলক্ষিত হয়৷ ভালো থাকা, খারাপ থাকা – সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা৷ সেই রাজনীতি কেমন রূপ নেবে ২০১৮ সালে, সেটাই দেখার৷

১. ২০১৮ সাল বাংলাদেশের জন্যে নির্বাচনের বছর৷ এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জাতীয় নির্বাচন৷ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচন৷ সিলেটসহ বড় বেশ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনও হবে এ বছর৷ যে সিটি কর্পোরেশনগুলোর মেয়র বিএনপির, অর্থাৎ যাঁরা গত পাঁচ বছর প্রায় কোনো কাজ করতে পারেননি, সরকার তাঁদের বারবার বরখাস্ত করেছে৷ এমনকি নানা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলেও রাখা হয়েছে তাঁদের৷

২. জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আসার আগে স্থানীয় সরকার তথা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার৷ বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা কমে৷ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা সম্ভবত আরও বেশি কমেছে৷ সর্বশেষ রংপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন৷ ঐ অঞ্চলে বিএনপির প্রায় কোনো ভিত্তি নেই৷ তারপরও ভোট বেড়েছে বিএনপির, কমেছে আওয়ামী লীগের৷ ইসলামী জোটের একজন প্রার্থী প্রায় ২৫ হাজার, অর্থাৎ বিএনপির সমান ভোট পেয়েছেন৷ অর্থাৎ বেড়েছে ইসলামী দলের ভোটও৷ আওয়ামী লীগের জন্যে তো বটেই, আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্যেও তা কম চিন্তার নয়৷

৩. ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে৷ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মোটেই আশাবাদী নয়৷ আনিসুল হক যে নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন, সেই নির্বাচনটিও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ৷ তখনকার চেয়ে এখন আওয়ামী লীগের অবস্থা মোটেই ভালো নয়৷ ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, আর সেই নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে না পারে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্যে তা বিপর্যয়কর হতে পারে৷ বলা বাহুল্য, এই আশঙ্কা থেকেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আগে আদৌ ঢাকা সিটির নির্বাচন হবে কিনা৷ যদিও আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু'দলই প্রার্থী প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে৷ নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ তবে এরপরও সংশয় কাটছে না৷ সীমানা বা নতুন ওয়ার্ডকে কেন্দ্র করে মামলা হলে বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে৷ সেক্ষেত্রে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যেতে পারে৷

৪. বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে৷ নতুন বছরের শুরুতে রায় দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এই মামলায় খালেদা জিয়া-তারেক জিয়ার যদি শাস্তি হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক থাকবে – তা নিয়ে শঙ্কা আছে৷ যদিও বিএনপির যে সাংগঠনিক অবস্থা, তা দিয়ে তারা আন্দোলন খুব বড়ভাবে করতে পারবে বলে মনে হয় না৷ তবে খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয়, তাতেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন বলেই মনে হয়৷ নিম্ন আদালতের শাস্তির পর উচ্চ আদালত, আপিল ডিসেম্বরের মধ্যে হয়ত নিষ্পত্তি হবে না৷ আর খালেদা জিয়া সাজা পেলে, আওয়ামী লীগ তা প্রচারণায় ব্যবহার করতে চাইবে৷ আওয়ামী লীগ বলবে, খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ৷ আওয়ামী লীগ মনে করছে এই প্রচারণায় তারা লাভবান হবে, কারণ দেশের মানুষ দুর্নীতিবাজদের ভোট দেবেন না৷

ওদিকে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়াকে সাজা দিলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না৷ উলটে জনমতের সহানুভূতি তাদের পক্ষে আসবে৷ তারা বলতে পারবে খালেদা জিয়ার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে৷ এই প্রেক্ষিতে বিএনপির ভোট আরও বাড়বে৷

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায় দুর্নীতি বা শান্তিতে রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা কমে না৷ স্বৈরাচার এরশাদের ক্ষেত্রে তা প্রমাণ হয়েছে৷ তবে খালেদা জিয়ার মামলা বা রায়কে কেন্দ্র করে রাজনীতি নানা বাঁক নেবে নতুন বছরের পুরো সময় জুড়ে৷

৫. দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া যদি শাস্তি পান, তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা – এমন প্রশ্ন এখন আছে, সামনেও থাকবে৷ সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইবে, যাতে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়৷ তবে সরকারের এই চাওয়ার বিষয়টি বিএনপি যে বুঝতে পারছে না, তা নয়৷ বিএনপির ভেতরের প্রধান অংশটি যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে৷ অবশ্য এজেন্সি নির্ভর চাকরিজীবী ক্ষুদ্র অংশটি বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে৷

৬. পর্দার অন্তরালে বিএনপি ভাঙার যে চেষ্টা গত কয়েক বছর অব্যাহত ছিল, নতুন বছরে তা-ও অব্যাহত থাকবে৷ নির্বাচনের সামনে নানা কৌশল-প্রলোভনে বিএনপি ভাঙার চেষ্টা দৃশ্যমান হতে পারে৷ বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা হবে৷

৭. কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেই আলোচনাও থাকবে বছর জুড়ে৷ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনাই থাকবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী৷ বর্তমান সংসদও কার্যকর থাকবে৷ একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে একজন সাধারণ প্রার্থী নির্বাচন করলে স্বাভাবিক হিসেব অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসনের সংসদ সদস্যের কথাই শোনার কথা৷ সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ‘সবার জন্য সমান সুযোগ' পরিবেশ কীভাবে তৈরি করবে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন৷

দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটা দেখানোর জন্য নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা এবং সর্বশেষ রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করেছে সরকার৷ কিন্তু সিটি নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না৷ সে কারণে সরকার এ সব নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি, এমন কথা আলোচনায় আছে৷ আলোচনাটা অসত্য নয়৷ এই ‘ফর্মুলা' অনুযায়ী ঢাকা সিটির নির্বাচন করার সাহস সরকার দেখাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে৷ আবার সিলেট, রাজশাহীসহ যেসব সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বিএনপির, তাঁরা যদি এবারও নির্বাচিত হন, তা সরকারের জন্যে কতটা স্বস্তিদায়ক হবে – সে প্রশ্নও সামনে আসছে৷ দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এমনটা প্রমাণ করতে চাইলে, বিভাগীয় শহরের মেয়র পদ আওয়ামী লীগের হারানোর সম্ভাবনাই বেশি৷ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভাগীয় শহর হাতছাড়া করা আদৌ সম্ভব কিনা, আওয়ামী লীগকে তা-ও বিবেচনা করতে হচ্ছে৷ আবার নির্বাচন না করাও ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করবে না৷

গোলাম মোর্তজা, সাংবাদিকছবি: Golam Mortoza

৮. নতুন বছরের রাজনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে জিনিসপত্রের দাম৷ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান স্লোগান ‘উন্নয়ন'৷ আর এই ‘উন্নয়ন' বলতে আওয়ামী লীগ কিছু রাস্তা চার লেন, কিছু ব্রিজ, কিছু ফ্লাইওভার, অর্থাৎ অবকাঠামো নির্মাণকে বোঝাতে চাইছে৷ আওয়ামী লীগের ধারণা, পদ্মাসেতুসহ এ সব অবকাঠামো নির্মাণ দেখে মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেবে৷ বাস্তবতা হলো, মানুষ যে এ ধরনের অবকাঠামো দেখে ভোট দেয়, তেমন কোনো নজির বাংলাদেশে নেই৷ তিন থেকে দশগুণ বেশি ব্যয়ে এ সব অবকাঠামো নির্মাণ, দুর্নীতি মানুষকে বেশি নাড়া দিয়েছে৷ ব্যাংক লুট, টাকা পাচার মানুষকে বেশি প্রভাবিত করেছে৷

৩২ টাকা কেজির চাল ৫৫-৫৮ টাকা, ৪৮ টাকা কেজির চাল ৭০-৭৬ টাকা হয়েছে৷ সরকার নানা কথা বলেছে, কিন্তু দাম কমাতে পারেনি৷ যখন বিদেশের বাজারে চাল ছিল, তখনও সরকার দেশের বাজারে দাম কমাতে পারেনি৷ দেশে নতুন ধানের মৌসুমেও চালের দাম কমেনি৷ বরং পেঁয়াজসহ সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে৷ গরিব মানুষের ওএমএস-এর চালের কেজি ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে৷ সেদ্ধ চালের পরিবর্তে আতব চাল দেয়া হয়েছে৷

বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও বারবার মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের ভেতরে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে৷ একদিকে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে গুম-অপহরণ-খুন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে৷ তার ওপর সুশাসনের অভাব খুব প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ নতুন বছরে এর যে অবসান ঘটবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷

৯. নতুন বছরে বা নির্বাচনের বছরে এ সব নেতিবাচক প্রভাবে আক্রান্ত হতে হবে আওয়ামী লীগকে৷ অর্থাৎ রাজনীতিতে প্রায় কোনো কিছু না করেও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে বিএনপি৷ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা – সেই আশঙ্কা বারবার আলোচনায় আসবে৷ এছাড়া ভারত-চীনের সমর্থন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলেও, অ্যামেরিকা-ইউরোপের একটা চাপ মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে৷ এক কথায়, আন্দোলনে না হলেও তর্ক-বিতর্কে উত্তপ্ত থাকবে ২০১৮ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি৷

এ নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ