সামনে যে নির্বাচন সেখানে তরুণ ভোটারদের একটা বড় অংশই প্রথমবার ভোট দেবেন। সেই ভোটে তরুণদের প্রভাব থাকবে কতটুকু? কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেবে তারা? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
‘‘তরুণরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী, অর্থাৎ, এস্টাবিলিস্টমেন্টবিরোধী। তাদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতাটা প্রবল। সবকিছু ভেঙেচুরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থাকে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে ভিশনটা দরকার, সেটার আর্টিকুলেশনের অভাব আছে।’’ছবি: Saad Abdullah/DW
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : তরুণ ভোটাররা নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলে?
মহিউদ্দিন আহমেদ :ভোটারদের মধ্যে তরুণদের অংশ যদি বেশি হয়, তাহলে তো অবশ্যম্ভাবীভাবে এর একটা প্রভাব পড়বে। আমরা দেখছি যে, এখন বাংলাদেশে যে ভোটার তাদের বেশিরভাগই তো তরুণ। তরুণ বলতে যদি আমরা ৩০-৩৫ বছর ধরি, তাহলে নাগরিকদের অধিকাংশই তরুণ। সুতারাং তারাই নির্ধারণ করে দেবে ভোটের ফলাফল। দ্বিতীয়ত, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে এই তরুণদের বেশিরভাগই জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। তারা এর আগে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। গত তিনটা নির্বাচনে তো ভোট দেওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। এর মধ্যে আবার অনেক নতুন ভোটার হয়েছে। তরুণদের মধ্যে তারা একটু প্রবীণ বা মধ্যবয়স্ক, তাদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বেশ প্রকট। কারণ, তারা ওইভাবেই বড় হয়েছেন। কিন্তু এই তরুণরা দেখেছে, তাদের চোখের সামনে সরকারের দুঃশাসন এবং বিরোধী দলের অপরাজনীতি- দু'টোই তারা দেখেছে।
আগের যে নির্বাচনগুলোকে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন বলি, সেখানে তরুণ ভোটারদের প্রভাব কতটুকু ছিল?
হ্যাঁ, ছিল তো। আমরা যদি ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করি, যে নির্বাচনে আমি প্রথম ভোট দিয়েছি, ওই নির্বাচনে তরুণদের ভোটের কারণে যে মেরুকরণ হলো, তার ফলে পাকিস্তান ভাঙলো এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো। প্রবীণদের ভোটে তো এটা হতো না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হওয়ার পরে মুক্ত পরিবেশে আমরা প্রথম ভোট দেখলাম ১৯৯১ সালে। সেখানেও কিন্তু তরুণরা ভোটে প্রভাব রেখেছে। এর আগে ১০ বছর ধরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে তো খালেদা জিয়া তার আপোষহীন ভাবমূর্তি দিয়ে তার দলের পক্ষে জয় ছিনিয়েছিলেন। সেখানে তরুণ ভোটারদের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। কারণ, ওই সময় বিএনপি ভেঙেচুরে গিয়েছিল। এরশাদ ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে তরুণদের যে সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রদল আন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখে এবং ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল জয়লাভ করেছিল। তার রেশ পড়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। এর পরের নির্বাচনগুলোতে ওই সময়ে যারা তরুণ ছিল, তারা দলীয় রাজনীতির মধ্যে বড় হয়েছে তো, ফলে তারা দলীয় হিসেবেই ভোটের হিসেব-নিকেশ করতো। এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। এখন আগের মতো হয়ত হবে না।
নির্বাচনে প্রথম ভোটারদের প্রত্যাশার কথা
নির্বাচন নিয়ে সব ভোটারেরই কিছু প্রত্যাশা থাকে৷ পরবর্তী নির্বাচনে এই প্রথম যারা ভোট দেবেন, তারা কী আশা করছেন? কেমন প্রার্থী পছন্দ তাদের? এসব জানতে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার প্রথম ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে...
ছবি: NurPhoto/IMAGO
নির্বাচন নিয়ে আশাভঙ্গ হবার ইঙ্গিতই পাচ্ছি: ইমরান নাফিস, লেখক ও চাকুরিজীবী
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে যারাই কাজ করছে বা করবে, আমার ভোটটা তাদেরই দেয়ার চিন্তা করছি। কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধি বাচাই করার মধ্যেই বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তে একটা ব্যাপার খুবই হতাশাজনক, সেটা হলো, এখানে রাজনৈতিক বিশ্বস্ততার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সামনের নির্বাচনেও এমন হতে পারে।আমি আগামী নির্বাচন নিয়ে আশাভঙ্গ হবার ইঙ্গিতই পাচ্ছি।
ছবি: DW
পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ চাই: অন্নি ইসলাম, চাকুরীজীবি
একটি স্বাধীন দেশে সরকার নির্বাচিত হবে ভোটের মাধ্যমে। সে দেশের সরকার পরিচালিত হবে আইনের শাসন এবং মেধাবীদের মাধ্যমে। এটিকে রাজনীতি বললে এটাই আমার রাজনৈতিক আদর্শ। আমি মনে করি, আগামী নির্বাচন হবে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন, যেখানে দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন ভোটকে একটি উৎসব মনে করবে। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো- দেশের বহুল প্রচলিত এ ধারণাকে আমি লালন করে আমার প্রথম ভোট প্রদান করবো।
ছবি: DW
নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে: আবির মিনহাজ, আইনজীবী
আমার রাজনৈতিক দর্শন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। কিন্তু শুধু দলীয় আদর্শে জাতীয়তাবাদ থাকা মুখ্য নয়, বরং জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ধারণ করে যারা রাজনীতি করবে, তাদের পক্ষেই আমার সমর্থন। আগামী নির্বাচন নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী, কারণ, জীবনের প্রথম ভোট প্রদান করবো একটি ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে। তবে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা, সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে।
ছবি: DW
আশা করছি আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে: আদিবা সায়মা খান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের বৈধতা নিয়ে ফ্যাসিবাদী সিস্টেম চালু করবে না, যে জুলাই গণহত্যার বিচারের নিশ্চিত আস্বাস দিতে পারবে এবং নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং নিপীড়িত শ্রেণির অধিকার লঙ্ঘন করবে না - আমি তাদেরই সাপোর্ট দেবো। আগামী নির্বাচন আশা করছি অংশগ্রহণমূলক হবে এবং নাগরিকরা নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে সঠিক প্রার্থী বেছে নেবে।
ছবি: DW
দলগুলো নিজেদের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত, তাই এখনো কারো প্রতি আশা রাখতে পারছি না: মোঃ মিরাজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
প্রথমবার ভোটার হিসেবে আমি আশাবাদী। আমার আদর্শ এমন দলকে সমর্থন দেওয়া, যারা খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা খাতে উন্নয়ন করবে, সেই সাথে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও বাক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাস্তবেই কাজ করবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি বা অন্যান্য দলগুলো নিজেদের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত৷ তারা এখন পর্যন্ত কোনো আশানুরূপ প্রতিশ্রুতি বা বাস্তবায়নের রূপরেখা দেয়নি। তাই এখন পর্যন্ত কারো প্রতি আশা রাখতে পারছি না।
ছবি: DW
নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের: ম্যাগনোলিয়া মন্ডল রিয়া, শিক্ষার্থী, নটর ডেম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
একজন নতুন ভোটার হিসেবে ভোট দেওয়ার সুযোগকে শুধু একটি অধিকার নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব মনে করি। ভোট দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ। আমার কাছে রাজনীতি মানে, মানুষের কল্যাণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমি চাই এমন প্রার্থীরা নির্বাচিত হোক, যারা সৎ, যোগ্য এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে এবং দেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করবে। নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং সমান সুযোগ নিশ্চিতের।
ছবি: DW
নির্বাচনে আমরা সকলের রাষ্ট্র বিনির্মাণে আমাদের ভোটাধিকার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে পারবো: দনওয়াই ম্রো, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম ভোটার হিসেবে দেশের বৈচিত্র্যময় জাতিস্বত্বার অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আমি ডানে বাম, বামে ডান, তথা মধ্যম পন্থা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে, দেশের স্থিতিশীলতা অর্জনে নির্বাচন ছাড়া আমাদের আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। আমি বিশ্বাস করি, বহুলপ্রত্যাশিত নির্বাচনটি হবে এবং আমরা সকলের রাষ্ট্র বিনির্মাণে আমাদের পবিত্র আমানত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবো।
ছবি: DW
জনগণকে খুশি করাই যে রাজনীতির মূল কাজ, সেটি আশা করছি নেতা এবং নেতা হতে ইচ্ছুকগণ বুঝতে পারবেন: দীপ্তি চৌধুরী, গণমাধ্যম ও উন্নয়ন কর্মী
আমার ধারণা, এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘোরানো ঘটনা হবে। এখানে চিরকাল রাজনীতিবিদরা এলিট শ্রেণি এবং জনগণ প্রলেতারিয়েত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।দলীয় নেতা নয়, বরং জনগণকে খুশি করাই যে রাজনীতির মূল কাজ, সেটি আশা করছি নেতা এবং নেতা হতে ইচ্ছুকগণ বুঝতে পারবেন।
ছবি: DW
আশা করি নির্বাচন অবাধ, রাজনৈতিক দলগুলোর হস্তক্ষেপহীন ও উৎসবমুখর হবে: হাবিবুর রহমান মোল্লা, চোখ হারানো জুলাই যোদ্ধা ও শিক্ষার্থী
যারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস করবে না, নিজেদের নতুন করে বাহুবলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪-এর জুলাইকে লালন করবে, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করবে, তাদেরকেই বিবেচনায় নেয়া হবে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, যেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে না, উৎসবমুখর নির্বাচন হবে বলে আশাবাদী। এর জন্য কমিশনকে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর উন্নয়নে মনযোগী হতে হবে।
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
নতুন ভোটাররা এবার ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিতে পারে?
নতুন ভোটাররা অতীতমুখী রাজনীতি পছন্দ করে বলে মনে হয় না। সুতরাং, তারা দেখবে সামনের দিনগুলোতে তাদের জন্য কারা কী প্যাকেজ প্রস্তাব করছে, তাদের সামনে কোনো আশাবাদ আছে কিনা৷ ভবিষ্যতের কর্মসূচিকেই তারা প্রাধান্য দেবে বলে মনে হয়। এখনকার কাজকর্ম এবং ভবিষ্যতের কর্মসূচিকেই তারা প্রাধান্য দেবে। ১৯৫২ সালে কে কী করেছে, ৬৬ বা ৭১ সালে বা ৯০ সালে কে কী করেছে, সেটা তারা হিসাবে ধরবে না। যেহেতু তারা এগুলো দেখেনি, ফলে এগুলো নিয়ে তাদের আবেগও নেই।
রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে কি কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে?
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রথাগত মডেল, অর্থাৎ, তরুণদের মধ্যে দলীয় সংগঠন করে। ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন করে। দলের ফর্মুলার মধ্যে সবাইকে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু সাধারণ তরুণরা এটা খুব একটা পছন্দ করে বলে মনে হয় না। সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অতীতের যে মডেল, তার থেকে তো বেরিয়ে আসতে পারছে না।
এবার সরকারও তরুণ ভোটারদের বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। কেন?
সরকার তো মনে করে, এই সরকার এসেছে তরুণদের আন্দোলনের ফলে। এই সরকারের ভিত্তিই তো তরুণরা। সুতারাং, তাদের উপক্ষো করা সম্ভব না।
গণমাধ্যম তরুণ ভোটারদের ভোটাদানে আগ্রহী করতে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির উপর এটা নির্ভর করে। যে গণমাধ্যমগুলো দলীয় রাজনীতির পক্ষে, তারা তাদের দল যা বলবে, সেভাবেই করবে। আর যে সমস্ত মাধ্যম স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা করে, তারা হয়ত দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে তরুণদের মনের কথাগুলো তুলে ধরতে পারে। এইভাবে তারা তাদের বিভিন্ন সংবাদ, প্রতিবেদনে বা নিবন্ধ-প্রবন্ধ দিয়ে আকৃষ্ট করতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ ভোটারদের মনোজগতে কতটুকু প্রভাব ফেলে?
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রায় পুরোটাই তরুণদের দখলে। এর মধ্যে দুইটা বিষয় দেখা যায়। একটা হলো গতানুগতিক রাজনীতির প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা এবং বিদ্রোহ। আর দ্বিতীয়ত হলো, খিস্তি, খেউর, গালাগাল ইত্যাদি। তরুণদের মনোজগতের দুইটা দিকই ফুটে ওঠে।
নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা-সংশয়
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েও মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সাথে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
জনমনে স্বস্তি ফেরেনি, নির্বাচন হবে কীভাবে?: রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, জনজীবনে স্বস্তি ফেরেনি, এর মধ্যে নির্বাচন হবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার ছিল। যেমন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনি যাত্রায় শামিল করার দরকার ছিল, যেটা তারা করেনি। তৃতীয়ত, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়েই কথা বলছে। ফলে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছবি: DW
রাজনৈতিক অনৈক্য ও নিরাপত্তাহীনতা নির্বাচনে বাধা : মনিরা শারমিন, যুগ্ম আহবায়ক, এনসিপি
মানুষের মধ্যে শঙ্কার অনেক কারণ আছে। মূলত দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। এটা নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এখন তো সবার মাঠে থাকার কথা। বিশেষ করে একটি দল যারা শুরু থেকেই নির্বাচনের কথা বলছে তারাও কিন্তু মাঠে নামেনি। তারাও জানে, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না৷ মানুষ গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
ছবি: Privat
জামায়াত-এনসিপির শর্ত শঙ্কা তৈরি করেছে : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কতগুলো যৌক্তিক কারণেই সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। মূল দল জামায়াত ও এনসিপি নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। যেগুলো দেখে মনে হতে পারে তারা নির্বাচন চায় না। এটাই মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে সবার নির্বাচনের মাঠে থাকার কথা। কিন্তু জামায়াত-এনসিপি যেসব শর্ত দিচ্ছে সেগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচন করবে না। ফলে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তো আছেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচন ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই : রোকসানা খন্দকার, আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি দল শর্ত দিচ্ছে, এটা না হলে, ওটা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এই শর্তের কারণে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে যতই শঙ্কা থাক, বর্তমান সরকার কিন্তু বুঝতে পেরেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই এতে মানুষ দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। ফলে যত শঙ্কাই থাক না কেন, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া এই সরকারের কোন বিকল্প নেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আইন শৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ: মোস্তফা ফিরোজ, সিনিয়র সাংবাদিক
তিনটা দলকে গুরুত্ব দেন ড. ইউনূস। এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। তাদের এই দাবির কারণে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আর বিএনপিও অগোছালো। তারেক রহমান দেশে নেই, প্রার্থী বাছাই করে যে তারা মাঠে নামবে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে অনিশ্চয়তা। আর আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ আসলে প্রস্তুত না। সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এই কারণেও শঙ্কা বেড়েছে।
ছবি: Privat
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে : সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, ইত্তেফাক
ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আছে। ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনকে কঠিন সংকটের মুখোমুখী ফেলতে পারে। সেটি হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিস-ইনফরমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। ভোট না হওয়া পর্যন্ত শঙ্কা থাকবে। এখনো নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি চাই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। এই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। যেখানে প্রতিটি দল সমান সুযোগ পাবে। আমার প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন সরকার নির্বাচিত হবে, যারা সত্যি জনগণের আশা ও কল্যাণ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্ভয়ে ভোট দিতে চাই : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণ ভেবেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই হবে পরিবর্তনের প্রতীক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি কমাবে, উন্নয়নের গতি বাড়াবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ব্যর্থতাই বেশি। জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে। একেবারেই স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে কোনো দল বিশেষ সুবিধা না পায়। জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি নির্ভয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই।
জাতীয় নির্বাচনে একজন তরুণ ভোটার হিসাবে আমার প্রধান প্রত্যাশা হলো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া। আমি চাই শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রযুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। দুর্নীতি কমানোসহ নারী হিসাবে আমার সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ প্রত্যাশা করি। সবশেষে, আমি এমন নেতৃত্ব চাই যারা ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়বে।
ছবি: Privat
নির্বাচন যেন অবাধ সুষ্ঠু হয় : আবু বকর অনিক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখনও কোন নির্বাচনে ভোট দেইনি। জীবনে প্রথম ভোট দেবো রাকসু নির্বাচনে। আর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে চাই। সেই নির্বাচনটি যেন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে এবং একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী প্রতিনিধির মাধ্যমে সংসদে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
10 ছবি1 | 10
তরুণ ভোটাররা রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কতটা সচেতন?
তারা তো সবই দেখছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গেলে আমরা দেখতে পারি যে, এখন আর আগের মতো সর্বজন-শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। সবাই সমালোচিত হচ্ছে। সবাইকেইতাদের কথা ও কাজের জন্য গালাগাল তরুণদের কাছ থেকে খেতে হচ্ছে।
বর্তমান রাজনীতির মাঠে অনেক তরুণকে দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেরা কতটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারছে?
বর্তমানে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে আমরা যাদের দেখছি, তাদের মধ্যে গুটিকয়েক দল তরুণ নেতৃত্বে আছে। তিন-চারটা হবে। এর সঙ্গে সর্বশেষ সংযোজন হলো এনসিপি। এদের অনেকেই গত ১৫ বছরের আন্দোলন, বিশেষ করে দুটো আন্দোলন আমি বলবো, একটা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং আরেকটা কোটা সংস্কার আন্দোলন- এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। এই আন্দোলন ছিল দলীয় রাজনীতির বাইরে। সুতরাং, দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথাবার্তা বলে এবং কর্মসূচি দিতে পারে, তাহলে তারা হয়ত ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
নতুন ভোটাররা এখনকার কাজকর্ম এবং ভবিষ্যতের কর্মসূচিকেই প্রাধান্য দেবে: মহিউদ্দিন আহমেদ
This browser does not support the audio element.
তরুণ ভোটাররা আসলে কী ধরনের প্রার্থী পছন্দ করে?
আমরা যাদের তরুণ বলছি, তাদের বেশিরভাগেরই চলাফেরা শহরাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলে তাদের সংগঠন সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এটা অনেক সময় লাগে। গ্রামে সংগঠন বলতে আমি বিএনপি আর আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো সংগঠন দেখি না। গ্রামে যারা সমাজপতি, বয়সে প্রবীণ, তাদের প্রভাব খুবই বেশি। সুতরাং, সেখানে যদি তরুণদের পথ বের করে নিতে হয়, তাহলে তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ, মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে সংগঠনের দরকার হয়। সেদিক দিয়ে তারা এখনো দুর্বল।
ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের ভাবনা কি একই ধরনের হয়?
অনেক ক্ষেত্রে একই ধরনের হয়, অনেক ক্ষেত্রে আলাদাও হয়। একদিকে ছেলে হোক, মেয়ে হোক, তারা সবাই তো তরুণ, আবার আরেকদিকে আমরা সবসময় তো জেন্ডার সেন্সিটিভিটির কথা বলি। তবে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ওই চেতনাটা কাজ করে। তবে বেশিরভাগের মধ্যে তো ওই সচেতনতাটা নেই। কারণ, সেভাবে তারা পারিবারিক শিক্ষাটাও পাইনি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যাদের বসবাস। সেখানে পরিবারের মুরুব্বি, সমাজপতিদের প্রভাবটা বেশি।
তরুণ ভোটারদের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো পরামর্শ?
আমরা সবসময়ই দেখেছি, তরুণরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী, অর্থাৎ, এস্টাবিলিস্টমেন্টবিরোধী। তাদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতাটা প্রবল। সবকিছু ভেঙেচুরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থাকে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে ভিশনটা দরকার, সেটার আর্টিকুলেশনের অভাব আছে। আমার মনে হয়, এটার দিকে তাদের নজর দেওয়া উচিত। সবকিছু অর্জন করা যাবে না। তার একটা সময় লাগবে। কতটুকু সময়ের মধ্যে কতটুকু অর্জন করা যায়। তরুণদের মধ্যে আবেগ একটু বেশি, বাস্তবতাবোধ সেই তুলনায় কম। তাদের অনেক বেশি বাস্তববাদী হতে হবে। আর সেটার জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে।