করোনার পর বিউবনিক প্লেগ। নতুন মহামারির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে চীনে। মঙ্গোলিয়ায় হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
করোনার পর নতুন মহামারির আশঙ্কায় চীন। রবিবার উত্তর চীনের মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এর আগে দক্ষিণ মঙ্গোলিয়াতেও দুই জনের শরীরে বিউবনিক প্লেগের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। রবিবারের ঘটনার পরে গোটা প্রদেশে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত এই অ্যালার্ট জারি থাকবে। কারণ, বিউবনিক প্লেগ সংক্রমক। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।
গত শনিবার উত্তর চীনের মঙ্গোলিয়ার একটি হাসপাতালে অজানা রোগ নিয়ে ভর্তি হন এক রোগী। শনিবার সন্ধ্যায় চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, ওই রোগী বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়েছেন। বিউবনিক প্লেগ একটি সংক্রমক এবং ভয়াবহ অসুখ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। বিউবনিক প্লেগ বোঝার পরেই চিকিৎসকরা স্থানীয় প্রশাসনকে খবর দেন। রবিবার তারই জেরে প্রশাসন তৃতীয় স্তরের হাই অ্যালার্ট জারি করে।
প্লেগ থেকে করোনা: রোগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে নয়, তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের গবেষণাগারে, এমন গুজব হরহামেশাই ছড়াচ্ছে৷ শুধু করোনা নয়, যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সব মরণব্যাধী নিয়েই এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিস্তার লাভ করেছে৷
ছবি: zecken.de
প্লেগের কারণ ইহুদিরা
১৪ শতকে ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে৷ কারো জানা ছিল না কোথা থেকে এর উৎপত্তি৷ একটা সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে এই রোগ ছড়িয়েছে৷ প্লেগের পেছনে আছে ইহুদিরাই; এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়৷ জোরপূর্বক উচ্ছেদও করা হয় অনেককে৷
ছবি: picture-alliance/National Museum of Health and Medicine
স্প্যানিশ ফ্লু জার্মানির অস্ত্র
১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই ভাইরাসের উদ্ভব রহস্য হয়ে ছিল৷ অনেকে মনে করতেন জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই জীবাণু আবিষ্কার করে৷
ছবি: picture-alliance / akg
এইডস ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
১৯৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইডস ছড়িয়ে পড়ে৷ পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এ নিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করে সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবি৷ বলা হয় ফোর্ট ড্রেট্রিক-এ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে মার্কিনিরা এইচআইভি উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীতে প্রয়োগ করা হয় বন্দী, সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সমকামীদের উপর৷ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি আজও জনপ্রিয়৷
ছবি: Imago Images/ZUMA Press/D. Oliveira
ইবোলার দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের
নব্বইর দশকে এইডস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে৷ কিন্তু এ সময় আফ্রিকায় নতুন করে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে৷ যুক্তরাষ্ট্র এইডস ছড়িয়েছে এমন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এবার দাবি করল ইবোলার জন্যও তারাই দায়ী৷ সঙ্গে অবশ্য ব্রিটেনকেও জড়ানো হল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেন্টাগনের এঁটেল পোকা প্রকল্প
২০১৯ সালে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথ দাবি করেন পেন্টাগন এঁটেল পোকাসহ বিভিন্ন কীটের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প চালিয়েছে৷ এই গবেষণা চলেছে ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে৷ স্মিথ সম্প্রতি এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন৷
ছবি: zecken.de
কোভিড-১৯ কৃত্রিমভাবে ছড়ানো
ডিজিটাল যুগে যেকোন ভুল তথ্য আগের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়৷ বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে৷ একইভাবে এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বপ্রেমীদের দাবি নভেল করোনা ভাইরাস চীনের কোন গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে৷ সেখান থেকেই তা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে৷ কেউ কেউ দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রই জীবাণুটি তৈরি করে চীনে পাঠিয়েছে৷ যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই৷
ছবি: picture-alliance/ZumaPress/Z. Maulana
6 ছবি1 | 6
চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থার দাবি, গত ১ জুলাই দক্ষিণ মঙ্গোলিয়াতেও দুই জনের শরীরে বিউবনিক প্লেগের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। এক জনের বয়স ২৭, অন্য জনের বয়স ১৭। জানা গিয়েছে, তাঁরা ম্যারমোটের মাংস খেয়েছিলেন। ম্যারমোট হলো এক ধরনের পাহাড়ি মূষিক। মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে অনেকেই এর মাংস খেয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বন্য ইঁদুর এবং ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর শরীরে এক ধরনের পোকা জন্মায়। সেই পোকার মাধ্যমেই বিউবনিক প্লেগের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়। দ্রুত এই ব্যাকটেরিয়া এক জনের শরীর থেকে অন্যের শরীরে ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে বলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা না হলে এই রোগ থেকে মৃত্যু হতে পারে।
বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার পরে হাই অ্যালার্ট জারি হয়েছে মঙ্গোলিয়ায়। বলা হয়েছে, সামান্য অসুস্থতা থাকলেও চিকিৎসকদের কাছে যেতে হবে। শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাড়িতে বসে থাকা যাবে না।
ফার্মাগুলোর লক্ষ্য কি পালটে যাচ্ছে?
করোনা ভাইরাসের ফলে বিশ্বের বড় বড় ফার্মাগুলোর লক্ষ্য কি বদলে যাচ্ছে? এতদিন জায়ান্টদের ব্যবসার মূল কেন্দ্রে ছিল ক্যানসার রোগের ঔষধ৷ কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের ব্যবসার মডেল সংক্রামক ভাইরাসকে ঘিরে তৈরি হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলছে৷
ছবি: imago images/blickwinkel
প্রতিবেদন
সোমবার নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইওয়াই৷ তারা দেখিয়েছে, ২০১৯ সালে ক্যানসার সংক্রান্ত ঔষধ তৈরি ও গবেষণার ফলে বড় ফার্মাগুলো ১৯ হাজার ৬০০কোটি ডলার আয় করেছে৷ অন্যদিকে, সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় তাদের আয় পাঁচ হাজার কোটির কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance
বদলে যেতে পারে
২০২০ সালে করোনার কারণে বড় ফার্মাগুলোর মনোযোগ এরই মধ্যে সরে এসেছে অনেকখানি৷ সামনে এই মহামারির চিকিৎসার ঔষধ তৈরিতেই মনোযোগ সবচেয়ে বেশি হবে৷ এমনটি ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, তা ব্যবসাসফল হবে তো?
ছবি: picture-alliance/PantherMedia
বড় ফার্মাগুলো কী করবে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় ফার্মাগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো থেকে সরে আসবে না৷ এছাড়া মহামারি সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা করা যায় না৷ তাই ব্যবসার সব মনোযোগ এখানে সরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকে৷
ছবি: picture-alliance/Zoonar
ঘোলাটে পরিস্থিতি
ইওয়াইয়ের গবেষণা বলছে, এরই মধ্যে অনেকগুলো একত্রিত ও অধিগ্রহণ (এম অ্যান্ড এ) পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেছে৷ ইওয়াই-এর গবেষক আলেক্সান্ডার নুইকেন বলেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ের সাথে খেলছে এবং দেখছে গ্রীষ্মের পর পরিস্থিতি কোনদিকে যায়৷’’
ছবি: Imago Images/Zuma/D. Husni
ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন খেলা
এরই মধ্যে ১৬০টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন ও ২৪০টি থেরাপিউটিক এজেন্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ প্রায় ৭০০টি টেস্ট বাজারে এনেছে বড় ফার্মাগুলো৷ তবে ব্যবসার এই খেলায় সেই জিতবে যে আগে ভ্যাকসিন বাজারে আনবে, এতে কোন দ্বিমত নেই৷ তবে এই খেলায় তাড়াহুড়ো করলে বিপদ বাড়বে বলে মনে করেন নুইকেন৷ তিনি মনে করেন, ৯৭% ভ্যাকসিন অনুমোদন পাবে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Spata
বিনিয়োগ বেড়েছে বলেই
বড় ফার্মাগুলো গেল কয়েক বছরে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে৷ জার্মান ফার্মা গবেষক গ্যের্ড স্ট্যুর্ৎস বলেন, ২০১৯ সালের নতুন গবেষণার জন্য বিনিয়োগের কারণেই ফার্মাগুলো বর্তমান সংকটে এত কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারছে৷
ছবি: picture-alliance/Geisler-Fotopress/S. Kanz
6 ছবি1 | 6
এ দিকে, বিউবনিক প্লেগ ছাড়াও আরও এক অসুখ নিয়ে চিন্তিত চীন। শুয়োরের শরীর থেকে একটি নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। নতুন এই ভাইরাসটি থেকেও মহামারি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটির সন্ধান পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, জেনোটাইপ চারের এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। শরীরের কোষের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে এই ভাইরাসটি রোগ ছড়ায়। দেশের বিভিন্ন শুয়োরের খামার থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চীনের উহান প্রদেশ থেকে প্রথম করোনা ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে যা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আপাতত করোনার প্রকোপ খানিক কমলেও দ্বিতীয় দফায় করোনা ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। তারই মধ্যে নতুন দুই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়, আশঙ্কায় চীন। আশঙ্কায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। করোনাতে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ধরে পড়েছে। ফের কোনও মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলে বিশ্বের চেহারা ভয়াবহ হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।