প্রায় প্রতিদিনই আসছে জঙ্গি আটকের খবর৷ গুলশান হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযান যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশান হামলার পর সাধারণ মানুষ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সচেতন এবং সোচ্চার হয়েছে৷ তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সহায়তা করছেন৷
এ সপ্তাহেই প্রকাশ করা হয়েছে ব্লগার অভিজিত্ রায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয় জনের ভিডিও ফুটেজ৷ আর তা প্রকাশ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)৷ তারই ধারাবাহিকতায় প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার প্রধান আসামি মইনুল ইসলাম শামীম ওরফে সিফাত ওরফে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মঙ্গলবার রাতে৷ গাজীপুরের টঙ্গিতে চেরাগ আলী মার্কেটে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা৷ তাকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল৷
মাসুদুর রহমান
একই রাতে আটক করা হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পাঁচ সদস্যকে৷ আটক জেএমবি সদস্যরা হলো রাশেদুজ্জামান, আব্দুল হাই, শাহবুদ্দিন রকি, ফিরোজ আহমেদ শেখ এবং সাইফুল ইসলাম৷ তাদের মধ্যে রাশেদুজ্জামান জেএমবির নারী শাখার প্রশিক্ষক ও দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমির৷
এর আগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে জেএমবির নয় জন নারী সদস্যকে আটক করা হয়৷ তারা তহবিল সংগ্রহ, সদস্য সংগ্রহ এবং যোগাযোগের কাজে নিয়োজিত ছিল৷
তবে এসবের মধ্যে ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকে পুলিশ গুলশান হামলার পর সবচেয়ে সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযান হিসেবে বিবেচনা করছে৷ এসব অভিযানে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা বিভাগ এবং ব়্যাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে৷
গুলশান হামলার পর এক মাসে সারাদেশে জঙ্গি সন্দেহে আটক হয়েছে ১৫৯ জন৷ সবচেয়ে বেশি আটক করা হয়েছে সাতক্ষীরা এবং সিলেট থেকে৷ জুলাই মাসে সাতক্ষীরা থেকে জঙ্গি সন্দেহে আটক হয়েছে ৪৫ জন এবং সিলেট থেকে ৩১ জন৷
সাতক্ষীরা ও সিলেটের বাইরে মানিকগঞ্জে ১১ জন, ঢাকায় ১০ জন, পাবনায় ৯ জন, খুলনায় ৮ জন, চট্টগ্রামে ১০ জন, নওগাঁয় ৬ জন, গাজীপুরে ৪ জন, কুমিল্লা, মাগুরা ও টাঙ্গাইলে ৩ জন করে আটক হয়েছে৷''
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
আটকদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৭ জন, হিযবুত-তাহরিরের ৩ জন, জামাত-শিবিরের ৩৪ জন, জেএমবির ৩২ জন এবং সংগঠনের পরিচয় না থাকা ৮৩ জন জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটক হয়েছে৷
পুলিশ আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছে৷ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন নামে ওই সংগঠনটিই আনসার আল ইসলাম নামে আবির্ভূত হয়৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গুলশান হামলার পর ঢাকাসহ সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিয়ার জোরদার করা হয়েছে৷ অভিযানে শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে কৌশলগত পরিবর্তন আনা হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষের সহায়তা নিচ্ছি৷ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছি৷ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য পেতে নিজস্ব অ্যাপস ব্যবহার করছি৷ অ্যাপসের মাধ্যমে এ পর্যন্ত আমরা ১০ হাজার অভিযোগ পেয়েছি৷ এসব অভিযোগ যাচাই বাছাই করে আমার কাজে লাগাচ্ছি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘গুলশান হামলার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছে, যা খুবই ইতিবাচক৷ সাধারণ মানুষ এখন নিজ উদ্যোগে তথ্য দিচ্ছে৷''