নতুন সভাপতি খাড়গে কি পারবেন কংগ্রেসের হাল ফেরাতে?
১৯ অক্টোবর ২০২২
২৪ বছর পর নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ কংগ্রেস সভাপতি হলেন। দ্বিতীয়বার এক দলিত নেতা কংগ্রেস সভাপতি হলেন।
বিজ্ঞাপন
কর্ণাটকের দলিত নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। হারালেন দক্ষিণ ভারতের আরেক নেতা কেরলের শশী থারুরকে।
মোট নয় হাজার পাঁচশজন ভোট দিয়েছিলেন। তারমধ্যে খাড়গে পেয়েছেন সাত হাজার ৮৯৭ ভোট এবং শশী থারুর এক হাজার ৭২ ভোট। কিছু ভোট বাতিল হয়েছে।
ঘোষণা করা না হলেও খাড়গে ছিলেন গান্ধী পরিবারের প্রার্থী। শশী থারুর ভোটে লড়ার আগে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেও, তাকে সমর্থন জানায়নি গান্ধী পরিবার। কংগ্রেসের অন্দরে শশী থারুর বিক্ষুব্ধ জি২৩ গোষ্ঠীর নেতা বলে পরিচিত।
গান্ধী পরিবার প্রথমে ঠিক করেছিল, তারা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটকে সভাপতি পদে সমর্থন করবে। কিন্তু গেহলট মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে চাননি, উল্টে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাই পরে খাড়গেকে সমর্থন করে গান্ধী পরিবার।
মল্লিকার্জুনের জয় নিয়ে
৮০ বছর বয়সি নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের জয় নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। শশী থারুরও প্রচারের জন্য দেশের অনেক রাজ্যেই ঘুরেছেন। কিন্তু শশী থারুরের বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য কংগ্রেস নেতারা খুব একটা উৎসাহ দেখাননি।
ফলে থাড়গের জিতবেন তা বোঝা যাচ্ছিল। দেখার ছিল, থারুর কত ভোট পান। দেখা গেল, বিপুল ব্যবধানেই জিতেছেন খাড়গে। তবে থারুর যে এক হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন, তা যথেষ্ট কৃতিত্বের বলে কংগ্রেস নেতারাই মানছেন।
হারে বিপর্যস্ত কংগ্রেস, ইস্তফার প্রস্তাব সোনিয়ার
পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর কংগ্রেসে আবার প্রবল ডামাডোল। ইস্তফা দিতে চাইলেন সোনিয়া, রাহুল, প্রিয়াংকা। তবে তা গৃহীত হয়নি। সোনিয়াকেই আবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ছবি: Atul Loke/Getty Images
কংগ্রেসের অবস্থা
পরপর দুইটি লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয় হয়েছে। তারপর একের পর এক বিধানসভা নির্বাচনে হারতে হয়েছে কংগ্রেসকে। গান্ধী পরিবার আর কংগ্রেসকে জেতাতে পারছে না। দলের মধ্যে প্রবীণ নেতারা একজোট হয়ে গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আলাদা দল করার চিন্তাভাবনা চলছে। সবমিলিয়ে দেশের সবচেয়ে পুরনো দলের অবস্থা খুবই খারাপ।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
ইস্তফা দিতে চাইলেন সোনিয়ারা
পাঁচ রাজ্যে হারের পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয়। রীতিমতো উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে সেখানে। বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী বলেন, কংগ্রেসের জন্য তিনি, তার ছেলে রাহুল ও মেয়ে প্রিয়াঙ্কা আরো একবার ত্যাগস্বীকার করতে রাজি। তারা সকলে এই হারের দায় নিয়ে ইস্তফা দিতে চান। তারা কেউ আর কোনো পদে থাকবেন না। নতুন নেতা নির্বাচন করা হোক
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.K. Singh
সোনিয়াকেই দায়িত্ব
ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা সোনিয়ার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সোনিয়াই দলের কার্যকরি সভাপতি থাকবেন। তিনি দলের পুনর্গঠনের জন্য যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবেন। কংগ্রেসের হাল ফেরানোর জন্য যা করার দরকার তিনিই করবেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
রাহুল গান্ধী: পদ নেই, নিয়ন্ত্রণ আছে
কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীর কোনো পদ নেই। কংগ্রেস সূত্র জানাচ্ছে, এখনো দলে তার কথাই শেষ কথা। তিনিই প্রতিটি নির্বাচনে প্রধান প্রচারকারী। সোনিয়া স্বাস্থ্যের কারণে আর প্রচারে যান না। রাহুলই সেটা সামলান। এবার প্রিয়াঙ্কাকে উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও অন্য রাজ্যে প্রচার করতে দেখা গেছে। প্রতিবার হারার পর রাহুল বলেন, তিনি ও দল এই হারের থেকে শিক্ষা নেবেন। কিন্তু তারপরেও প্রতিটি নির্বাচনে একই ছবি দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Kiran
প্রিয়াঙ্কা পারলেন না
প্রিয়াঙ্কার উপর উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব ছিল। তিনি সেখানে মেয়েদের ভোট পেতে স্লোগান দিয়েছিলেন, লড়কি হুঁ, লড় সাকতি হুঁ। মেয়েদের ঢালাও প্রার্থী করেছিলেন। সবচেয়ে বেশি জনসভা তিনি করেছেন। তারপরেও দেখা গেল, ৯৭ শতাংশ আসনে কংগ্রেস প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে একসময় কংগ্রেস নেতারা ব্রক্ষ্মাস্ত্র বলতেন, সেই প্রিয়াঙ্কা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ।
ছবি: Getty Images/AFP/A. Deep
কংগ্রেসের হাতে
কংগ্রেস এখন রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় আছে। আর মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে তারা জোটের সঙ্গে ক্ষমতায় আছে। ভারতে আর কোনো রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি পাঞ্জাব এখন আপের দখলে। এবার গোয়া, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে। উপরের ছবিটি রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের।
ছবি: Imago Images
রাজ্যসভায় শক্তি কমবে
যত রাজ্য কংগ্রেসের হাতছাড়া হচ্ছে, ততই রাজ্যসভায় তাদের শক্তি কমছে। এখনো রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতার পদ কংগ্রেসের হাতে, কিন্তু তা অদূর ভবিষ্যতে হাতছাড়া হতে পারে। কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, হরিয়ানা সহ বহু রাজ্যে তাদের হাতছাড়া হয়েছে। হারের এই মিছিল চলতে থাকলে তাদের অবস্থা ভবিষ্যতে আরো খারাপ হতে বাধ্য।
ছবি: picture-alliance/dpa/STR
কংগ্রেসে বিদ্রোহ
বেশ কিছুদিন হলো, প্রবীণ নেতারা গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। মোট ২৩ জন নেতা এই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীতে আছেন। তাদের বলা হয়, কংগ্রেসের জি২৩। এর মধ্যে গুলাম নবি আজাদ, কপিল সিবাল, আনন্দ শর্মারা আছেন। গত দুইদিনে তারা দুইবার মিলিত হয়েছেন। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা আলাদা দল গঠন করতে পারেন বলেও কংগ্রেস নেতাদের একাংশ মনে করছেন। উপরের ছবিটি গুলাম নবি আজাদের।
ছবি: AP
চিদাম্বরমের বক্তব্য
সাবেক মন্ত্রী ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম বলেছেন, পাঞ্জাবে আপ ও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে, সেই জোটে জুনিয়ার পার্টনার হয়ে চলতে হবে কংগ্রেসকে। তার এই স্বীকারোক্তি কংগ্রেস মহলে আলোড়ন ফেলেছে।
ছবি: UNI
কী হবে?
সোনিয়া গান্ধী হেরে যাওয়া পাঁচ রাজ্যের সভাপতিকে বরখাস্ত করেছেন। এর মধ্যে পাঞ্জাবে নভজ্যোত সিং সিধুও আছেন। কিন্তু কংগ্রেসেই প্রশ্ন উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত কি যথেষ্ট? কংগ্রেস ও তার নেতাদের চাল-চরিত্র-চেহারা বদল না হলে দল কি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? গান্ধী পরিবার কি দলকে জয়ের পথে আনতে পারবে? নাকি, এভাবেই ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে কংগ্রেস?
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
থারুরের অভিযোগ
ভোট গণনার মাঝপথেই গুরুতর অভিযোগ করেন শশী থারুর। তিনি বলেন, উত্তরপ্রদেশে ভোটে গুরুতর বেনিয়ম হয়েছে। সেখানে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়নি। ভোটে কারচুপি হয়েছে। ভোটে জালিয়াতি হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের ঘটনা মেনে নিলে কী করে এই ভোটকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বলা যাবে?''
ফলাফল বেরনোর পর অবশ্য শশী থারুর বলেছেন, তিনি খাড়গেতে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
কংগ্রেসের হাল ফিরবে?
নতুন সভাপতি পেল কংগ্রেস। গান্ধী পরিবারের বাইরের নেতা দীর্ঘদিন পরে দলের সভাপতি হলেন। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কংগ্রেসের হাল কি ফিরবে? ২০১৪ সালের পর থেকে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে একটার পর একটা নির্বাচনে কংগ্রেস হেরেই চলেছে। বিভিন্ন রাজ্যে দলের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে প্রায় মুছে দিয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ। এতদিন হিমাচল ও গুজরাটে বিজেপি-র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কংগ্রেস। কিন্তু এবার দুই রাজ্যে আপ খুবই তোড়জোড় করে ভোটে লড়ছে। আপ নেতারা হিমাচল নিয়ে খুবই আশাবাদী। গুজরাটেও প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গিয়ে প্রচার করছেন কেজরিওয়াল। নরেন্দ্র মোদীও বেশ কিছুদিন আগে থেকে দুই রাজ্যে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস সেভাবে জাগেইনি।
নতুন সভাপতিকে প্রথমেই দুই রাজ্যের ভোটের মুখে পড়তে হবে। সেখানে কংগ্রেসের ফল খারাপ হলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা উঠছে, কংগ্রেস সভাপতি কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, না কি, রিমোট কন্ট্রোল সেই গান্ধী পরিবারের হাতেই থাকবে? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমবঙ্গের এক কংগ্রেস নেতা ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''খাড়গে তো গান্ধী পরিবারের প্রার্থী। তাই তিনি পরিবারের কথা শুনবেন, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।''
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''খাড়গেকে তো কংগ্রেসের হাল ফেরাবার জন্য সভাপতি করা হয়নি। মোদী বারবার পরিবারতন্ত্রর কথা বলছিলেন। সেই অভিযোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য করা হয়েছে। খাড়গে পরিবারের কথা শুনে চলবে। পরিবারই কংগ্রেস চালাবেন।''
শুভাশিসের মতে, ''শশী থারুর সভাপতি হলে পরিবারের সঙ্গে সংঘাত হত। সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো। অতীতে বহুবার হয়েছে। কিন্তু গান্ধী পরিবার সেটা চায়নি।''
কী হবে রাহুল গান্ধীর?
তখনো ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। তখনই রাহুল জানিয়ে দেন, খাড়গে তার ভূমিকা ঠিক করবেন। তিনি জানিয়েছেন, কংগ্রেসে সভাপতি হলেন সর্বোচ্চ। তিনিই সবকিছু ঠিক করেন। সভাপতি যা বলবেন, তিনি সেই ভূমিকা পালন করবেন।
তবে কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, রাহুল গান্ধী এখন যেভাবে চলছেন, পরেও সেভাবেই চলবেন। তিনিই দলের মুখ থাকবেন। কিন্তু কোনো পদে থাকবেন না। তাতে কংগ্রেসের কি খুব বেশি লাভ হবে?