এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নদী সুরক্ষার আন্দোলন করছি৷ এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা অম্লমধুর৷ অন্তত অর্ধশত নদী নিয়ে এই মুহর্তে চলছে নানামাত্রিক আন্দোলন৷ এই আন্দোলন সংগঠিত করা একটি কঠিন কাজ৷
বিজ্ঞাপন
বুড়িগঙ্গার তীরে অবৈধ স্থাপনা৷ছবি: Amir Smith
আন্দোলনের ফলে সমাজে একটি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে৷ আমরা অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে নদী উদ্ধারও করেছি৷ আগামীতে দেশজুড়ে নদী আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে পরিণত করার অভিপ্রায় আছে৷
নদী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা স্বল্প কথায় ব্যক্ত করা কঠিন৷ অযুত অভিজ্ঞতা নদী আন্দোলনের৷ যতই দিন গড়াচ্ছে ততই নদীকে বুঝতে শিখছি৷ ততই দেখছি নদীর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বশীলদের কি ভয়াবহ অবহেলা৷ অভিজ্ঞতা যত বাড়ছে ততই বাড়ছে নদীকর্মী হিসেবে নিজের দায়িত্বশীলতা৷ নদীকে বোঝা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷
নদী আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনকে অনেকটা অনিশ্চিত করে তুলেছি৷ দীর্ঘদিনে খুব কাছে থেকে জেনেছি- অবৈধ দখলদারদের রাজনৈতিক কোন দর্শন নেই, অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখতে দখলদারেরা সর্বদলীয় জোট করতে কোন দ্বিধা করে না৷ অবৈধ দখলদারিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য পশুর চেয়েও বেশি হিংস্র হতে পারে নদীদস্যুরা৷ সেটিও কাছে থেকে দেখছি৷ কখনো কখনো মনে হয় যেকোনো দিন অবৈধ দখলদারেরা জীবন নাশের কারণ হয়ে উঠবে৷ জীবনের হুমকিকে সাথে নিয়েই নদী সুরক্ষার আন্দোলনের পথে হাঁটছি৷ থানায় সাধারণ ডায়রি করতে হয়েছে৷ নদীর আন্দোলন করতে গিয়ে শতাধিক বিঘার এক অবৈধ দখলদার আমার নামে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলার আবেদন করেছে৷ মামলাটি গ্রহণ করা যাবে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে আদালত৷ আমার নামে কেবল নয় ওই মামলার আবেদনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, বার্তা সম্পাদক রাজিব হাসান, প্রতিবেদক জহির রায়হান জুয়েলকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ আমি যখন কোর্টে গিয়ে আইনজীবীদের সাথে এসব নিয়ে আলাপ করি তখন দুধরনের অনুভূতি হয়৷ কখনো মনে হয় দেশের জন্য লড়তে এসে আমাকে কোর্টে ঘুরতে হয়েছে৷ আবার এটাও মনে হয়, নদী রক্ষার আন্দোলন তীব্র করতে পেরেছি৷ নয়তো তারা কেন কোর্ট পর্যন্ত যাবে?
দূষণে, দখলে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের নদী
বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর মতে, দেশে নদীর সংখ্যা ৯০০র মতো৷ কিন্তু দখলের কারণে এর অনেকগুলোর আকার ছোট হয়ে এসেছে৷ সেই সঙ্গে আছে দূষণ সমস্যা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
নদীর সংখ্যা
বাংলাদেশে ঠিক কতগুলো নদী আছে তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না৷ তবে গত ২৩ জানুয়ারি সিলেটে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী জানান, দেশে নদীর সংখ্যা ৮৫৭টি৷ এই তথ্য আরও যাচাই-বাছাই করে কমিশনের ওয়েবসাইটে (https://nrcc.gov.bd/) প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এখনও তা করা হয়নি৷ অবশ্য বুধবার তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, নদীর সংখ্যা এখন কিছুটা বেড়ে ৯০০ হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দখলদারদের তালিকা
জমি দখলের মতো নদী দখলও একটি বড় সমস্যা৷ সাধারণত প্রভাবশালীরাই নদী দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলেন৷ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে সারা দেশে নদ-নদীর এমন ৬৮ হাজার দখলদারের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ জেলাওয়ারী দখলদারদের নাম ও তাদের স্থাপনা সম্পর্কে সেখানে তথ্য দেয়া আছে৷ ছবিতে বুড়িগঙ্গার তীরে অবৈধ স্থাপনা দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Amir Smith
আরেক তালিকা
নদী দখলদারদের তালিকা তৈরি করতে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল নদী রক্ষা কমিশন৷ এর মাধ্যমে ৩৭ হাজার ৩৯৬ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ তবে সেই তালিকা ওয়েবসাইটে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে৷ অবশ্য কমিশনের চেয়ারম্যান বুধবার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ঐ তালিকা যাচাইবাছাইয়ের জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে৷ সেখান থেকে হালনাগাদ হয়ে আসলে তালিকাটি ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে৷
ছবি: Amir Smith
দূষণ নিয়ে গবেষণা
বেসরকারি সংস্থা ‘রিভারস অ্যান্ড ডেল্টা রিচার্স সেন্টার’ আরডিআরসি ৫৬টি প্রধান নদ-নদীর দূষণ নিয়ে বছরব্যাপী গবেষণা করে ১৪ মার্চ প্রতিবেদন (https://shorturl.at/cpIM9) প্রকাশ করেছে৷ গবেষণায় নদীগুলোর পানির গুণাগুণ পরিমাপ করে দেখা গেছে শুধু শহর বা উপশহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নদীতেও প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্যের দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে৷ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালিত হয়৷
ছবি: Tofazzal Sohel
সবচেয়ে দূষিত তিন নদী
আরডিআরসি-র গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত তিন নদী গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং৷ এছাড়া বাকি ৫৩টি নদীও অতিমাত্রায় দূষিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷
ছবি: Palash Prodhan
লবণদহ নদীতে দূষণ
গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে এই নদী সদর উপজেলার বানিয়ারচালা, ভবানীপুর হয়ে মির্জাপুরে গিয়ে শালদহ নদীতে গিয়ে মিশেছে৷ শিল্পবর্জ্য, পৌর বর্জ্য ও প্লাস্টিক এই নদীর দূষণের কারণ বলে জানিয়েছে আরডিআরসি৷
ছবি: Palash Prodhan
হাড়িধোয়ায় দূষণ
নরসিংদী শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী৷ কলকারখানার বর্জ্য, পৌর এলাকার ময়লা-আবর্জনা, বাজারের পরিত্যক্ত ময়লা ও নদীর পাড়ে বাস করা মানুষেরা নিয়মিত আবর্জনা ফেলায় হাড়িধোয়া নদী দূষিত হচ্ছে৷
ছবি: Asif Ahasanul
সুতাং নদ দূষণের কারণ
হবিগঞ্জ সদর, শায়েস্তাগঞ্জ, লাখাই এবং চুনারুঘাট উপজেলার ওপর দিয়ে সুতাং নদ প্রবাহিত হয়েছে৷ শায়েস্তাগঞ্জের অলিপুরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে সুতাং নদের পানি দূষিত হচ্ছে৷
ছবি: Tofazzal Sohel
বিভাগওয়ারী তথ্য
গবেষণার ৫৬টি নদীর ১৯টি ঢাকা বিভাগের, যার সবগুলোই মারাত্মক দূষণের শিকার৷ এছাড়াও জরিপে খুলনার সাতটি, সিলেটের পাঁচটি, চট্টগ্রামের আটটি, রাজশাহীর দুইটি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের চারটি নদীর দূষণমাত্রা দেখা হয়৷ ছবিতে সাভারে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত আবর্জনার স্তূপে ময়লা ফেলতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
দূষণের ধরন
৫৬টি নদীর মধ্যে ১৬টি গৃহবর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের শিকার৷ অন্যদিকে ৩৫টি নদী প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য এবং পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে দূষিত হয়েছে৷ রংপুরের কেবল তিনটি নদী ছাড়া দেশের সব বিভাগের নদীই শিল্পকারখানার দূষণের শিকার৷ উপরের ছবিটি গাজীপুরের মাওনায় তোলা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
অবৈধ দখলদারেরা আমার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাহীন কুৎসা রটানোর কাজ করে৷ এ বছর শুরুর দিকে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায় আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছে অবৈধ দখলদারদের জোট৷ ওই সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নেতারা উপস্থিত ছিলেন৷ তারা প্রত্যেকে বড় বড় অবৈধ দখলদার৷ আমার গায়ে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী তকমা লাগানোর চেষ্টা বহুবার করেছে৷ আমরা নদীর জন্য কর্মসূচি দিয়েছি সেই কর্মসূচি পণ্ড করার জন্য কখনো কখনো বঙ্গবন্ধুর নামে মিছিল করে আমাদের কর্মসূচিতে হানা দিয়েছে৷
নদীকর্মীদের নদীযোদ্ধা বলেই উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ আমার সাথে যারা নদীর কাজ করেন তারাও অনেক ঝুঁকি নিয়েই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন৷ মাঠপর্যায়ে নদীর জন্য অকুতোভয় অনেক কর্মী আছেন৷ যারা নদীর আন্দোলনকে এগিয়ে নেন৷ নদীর আন্দোলন অনেক সময় মনে করিয়ে দেয় মহান মুক্তিযদ্ধের কথা৷ নদীর আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী শত্রুতে পরিণত হয়েছেন৷ স্বার্থে আঘাত লাগার সাথে সাথে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন৷ তবে নদী আন্দোলনকারীদের সাধারণ মানুষ খুব পছন্দ করেন৷ প্রত্যন্ত গ্রামে নদীর পাড়ে গেলে সাধারণ মানুষেরা এসে পরম ভালোবাসায় আপন করে নেয়৷ এই ভালোবাসা একটি বড় শক্তি৷
ধীরে ধীরে কখন যে নদী আন্দোলনের অতল গভীরে ঢুকে পড়েছি টেরই পাইনি৷ এক নদীর সংকট থেকে আরেক নদীর সংকট নিয়ে কাজ করছি৷ ধ্যানে-জ্ঞানে এখন নদী ভাবনা৷ সময় পেলেই নদী নিয়ে পড়ি, নদীবিষয়ক লিখি৷ কোনো নদীর সংকটের কথা জানার পর ওই নদীর জন্য কিছু করতে না পারলে মনটা খারাপ হয়৷ এক যুগের চেয়ে বেশি সময় ধরে যে কাজের অভিজ্ঞতা সেই অভিজ্ঞতা এখন আমাকে অনেক বড় কাজের স্বপ্ন দেখায়৷ আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের লড়াইয়ে দেশের সব নদীগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব৷
নীলফামারী জেলায় আমরা দেওনাই (শাখানদী) নদী অবৈধ দখল হওয়া থেকে রক্ষা করেছি৷ নীলফামারীর একজন ভূমি কর্মকর্তা ওই নদীকে জলাশয় ঘোষণা করতে কোন অসুবিধা নেই মর্মে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন৷ আমি সেখানে গিয়ে ‘দেওনাই নদী সুরক্ষা কমিটি' গঠন করি৷ আমি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছি৷ অনেকদিন লেগে থেকে ওই কমিটির কার্যক্রম বৃদ্ধি করে আমরা ওই নদীটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি৷
রংপুর জেলার শালমারা নদীতে অনেক অবৈধ দখল ছিল৷ নদীর মাঝখানে দখল থাকায় নদীটি খনন করাও যাচ্ছিল না৷ সেখানে গত শতকের আশির দশকেও আন্দোলন হয়েছিল৷ নদীটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ আমি খবর পেয়ে নদীতীরবর্তী মানুষেদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করি৷ সেখানে শুরু হয় নতুন আন্দোলন৷ অনেকের রক্তচক্ষুর দিকে না তাকিয়ে নদীটি সরকারিভাবে উদ্ধার করা হয়৷ সেখানে আন্দোলন শেষ হয়নি৷ অবৈধ দখলদার কোর্টে গেছে অবৈধ দখল রক্ষা করতে৷ এরই মধ্যে দেখছি ‘শালমারা' নদী জেলা প্রশাসন বদ্ধ জলমহাল হিসেবে তিন বছরের জন্য লিজ দিয়েছে৷ ওই লিজ বাতিলের জন্য আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে৷
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় একটি নদী আছে৷ উৎস থেকে শুরু করে কোথাও চাকিরপশার, কোথাও মরা তিস্তা আবার কোথাও বুড়িতিস্তা নাম নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ এই নদীটির রাজারহাট এবং চাকিরপশার ইউনিয়নে পাঁচটি মৌজায় প্রায় ৩০৬ একর জমি বিল শ্রেণীভুক্ত৷ এই নদী উদ্ধার করতে গিয়ে দেখলাম ওই স্থানে ভূমিদস্যুরা ২৬৯ একর ৭২ শতক ব্যক্তির নামে লিখে নিয়েছে৷ এটি উদ্ধারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি৷
অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, পরিচালক, রিভারাইন পিপল এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকছবি: Private
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণত অবৈধ দখলদারদের পক্ষে থাকে৷ তারা এমনভাবে পক্ষ নেবে বোঝার উপায় নেই৷ বোঝা যায় যখন মুখে কেবল মধুর কথা বলে কিন্তু উদ্ধারে কোনো কাজই করে না তখন৷ দেশের নদীগুলোকে মেরে ফেলার সবরকম আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে৷ দেশে নদী রক্ষার জন্য একক কোন মন্ত্রণালয় নেই৷ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থাকলেও তাদের বিশেষত কাজ করার কোন ক্ষমতা নেই৷ একটি নদীর যে কতভাবে সর্বনাশ করা হয়েছে তা নদী রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে বুঝেছি৷
নদীর চেয়ে ছোট সেতু করে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়৷ নদীর মাঝ বরাবর একটি অংশ ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়, যাতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়৷ নদীতে আড়াআড়ি সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করা হয়৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ দিয়ে অসংখ্য শাখানদী এবং উপনদীর উৎসমুখ এবং মিলনস্থল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ নদীর শ্রেণী পরিবর্তন করার আইনগত কোন সুযোগ নেই৷ সেই নদীর জমি কবুলয়িলাত সূত্রে, বন্দোবস্ত সূত্রে প্রশাসন থেকে ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়৷ পরবর্তীতে সেই নদীর শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়৷ রিভিশনাল সার্ভেতে (আরএস) দেখা যাচ্ছে সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) নকশার চেয়ে নদীর জমি কমে যাচ্ছে৷ এই জমি কমানো দেশের সংবিধান, আইন এবং উচ্চ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন৷
নদী আন্দোলন খুব কঠিন কাজ হলেও যখন নদী উদ্ধার হয়, নদীর সংকট কমে আসে তখন পরম ভালো লাগা কাজ করে৷ আগামী বিশ্বকে সুস্থ রাখতে হলে নদীগুলো সুরক্ষার কোন বিকল্প নেই৷ আমরা আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে নদীর কাজ করি৷ যত প্রতিকূল হোক এ যাত্রা, তবু থেমে যাবার নয়৷ নদীর সুরক্ষার আন্দোলন চলছে, চলবে৷
‘মৃত’ নদী বুড়িগঙ্গা
শিল্প কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের কারণে শুকনা মৌসুমে বুড়িগঙ্গার পানির রং সবসময় কালো থাকে৷ এই সময় সেখানে মাছ বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী থাকে না৷ এই অবস্থাকে পরিবেশকর্মীরা ‘বায়োলজিক্যালি ডেড’ বলে ডাকেন৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
নদীতে মাছ নেই
দুই দশক আগেও বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরে জীবনযাপন করতেন ৭০ বছর বয়সি নুরুল ইসলাম৷ কিন্তু দূষণের কারণে এখন মাছ পাওয়া যায় না৷ তাই এখন ভ্যানে খাবার বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে৷ ‘‘২০ বছর আগে নদীর পানি ভালো ছিল৷ আমরা গোসল করতাম৷ অনেক মাছ ছিল৷ আমাদের অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম৷ এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে,’’ রয়টার্সকে জানান নুরুল ইসলাম৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
দূষণ ও দুর্গন্ধ
শিল্প কলকারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গার পানি এখন এত দূষিত হয়েছে যে পানির রং কালো হয়ে গেছে৷ শুধু বর্ষার সময় রং একটু ভালো থাকে৷ বুড়িগঙ্গার পানি থেকে এখন প্রায় সারা বছরই দুর্গন্ধ বের হয়৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
পোশাক খাতও দায়ী
বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে চীনের পর বাংলাদেশের অবস্থান৷ তবে পরিবেশ কর্মীরা বলছেন, বুড়িগঙ্গার পরিণতির জন্য পোশাকখাত অনেকাংশে দায়ী৷ কারণ প্রতিদিন অনেক পোশাক কারখানার বর্জ্য পরিশোধন না করেই বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে৷ পলিথিন আর প্লাস্টিক বর্জ্যে বুড়িগঙ্গার তলদেশ ভরে উঠছে৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
চর্মরোগ ও চোখ জ্বালাপোড়া
৪৫ বছর বয়সি মাঝি সিদ্দিক হাওলাদার (মাঝে) নিজের নৌকাতেই বাস করেন৷ ‘‘যারা নদীতে গোসল করে তাদের চর্মরোগ দেখা দেয়৷ মাঝেমধ্যে আমাদের চোখও জ্বলে,’’ বলেন তিনি৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
নিয়ম না মানা
নদী দূষণ ঠেকাতে ১৯৯৫ সালে সরকার শিল্প কারখানায় ‘এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বসানো বাধ্যতামূলক করে৷ কিন্তু অনেক কোম্পানি নিয়ম মানছে না৷ সরকার নিয়মিত নজরদারি করলেও কর্মী সংকটের কারণে সবসময় সেটা সম্ভব হয় না বলে জানান সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
বিজেএমইএর বক্তব্য
বিজেএমইএর কর্মকর্তা শহিদুল্লাহ আজিম বলছেন, সব পোশাক কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে৷ ‘‘এটা বাধ্যতামূলক এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা নিশ্চিত করতে হলে এই আইনের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়,’’ বলে জানান তিনি৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
‘বায়োলজিক্যালি ডেড’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের শরিফ জামিল বলছেন, শিল্প কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্য নিয়মিতভাবে বুড়িগঙ্গায় ফেলার কারণে নদীটি এখন হুমকির মুখে রয়েছে৷ ‘‘শুকনা মৌসুমে নদীতে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণী পাওয়া যায় না৷ আমরা একে বায়োলজিক্যালি ডেড বলি,’’ জানান তিনি৷