1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নদী রক্ষা কমিশন : নদী ‘কমায়’, দখলদার বাড়ায়

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২ জুন ২০২৩

হিসেব বলছে, বাংলাদেশে নদী আছে মোট ৮৫৭টি৷ ২০১৯ সালে নদীর ৫৭ হাজার ৩৯০ জন দখলদার চিহ্নিত করে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে উচ্ছেদ করা হয়৷ কিন্তু ২০২০ সালে দখলদারের সংখ্যা আরো বেড়ে হয়ে যায় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন!

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দূষিত তিন নদীর একটি নরসিংদীর হাড়িধোয়া৷
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দূষিত তিন নদীর একটি নরসিংদীর হাড়িধোয়া৷ছবি: Asif Ahasanul

দখলদারের তালিকার বাইরে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের আওয়তায় ৪৮টি নদীর ৩৮ হাজার অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারদের তালিকাও তৈরি করা হয়৷ কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সেই তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর তালিকাটা সরানোর সিদ্ধান্ত হয়৷ এই প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকা খরচ করা হলেও কাজ কতটা হয়েছে, সুফল কতটা পাওয়া যাবে সে প্রশ্ন রয়েছে৷

এই প্রকল্পের সমীক্ষায় সবচেয়ে বেশি চার হাজার ৭০৭টি স্থাপনা পাওয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে৷ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে দুই হাজার ৪৯৩টি স্থাপনা, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ৮৯৪টি, ধলেশ্বরীতে ৮৮৬টি, তুরাগ নদে ৬৬১টি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ এছাড়া করতোয়ায় ৮০৭, কক্সবাজারের বাঁকখালীতে ২১৮, গোমতীতে দুই হাজার ১২০টি, পার্বত্য জেলার সাঙ্গুতে ৩৩৩ স্থাপনাসহ আরো কিছু নদীতে অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়৷
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এটা আসলে আরো পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হবে৷ তার আগে প্রকাশ করা ঠিক হবে না৷ এখন আমরা সিএস দাগ ধরে তালিকা করছি৷’’

তবে সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান হাওলাদার মনে করেন, ‘‘এই তালিকা ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া ঠিক করা হয়নি৷ এতে দখলদাররা উৎসাহিত হয়, দখল আরো বেড়ে যায়৷ আমরা প্রথম দুটি তালিকা করার পর প্রকল্পের আওতায় সুনির্দিষ্ট ৪৮টি নদীর দখলদার চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে এসেছিলাম৷’’

তার কথা, ‘‘এই তালিকা প্রকাশের ম্যান্ডেট কমিশনের আছে, আদালতই আদেশ দিয়েছেন প্রকাশ করতে৷ আর আইন না বুঝলে এবং কমিশনের মধ্যে অসততা থাকলে এমন হয়৷’’

নদী ও দখলের সার্বিক চিত্র

নদী রক্ষা কমিশন বলছে, দেশে এখন দেশে প্রকৃতপক্ষে ৮৫৭টি নদী আছে৷ তবে তারা আরো যাচাইবাছাই করে তালিকা ওয়েব সাইটে প্রকাশ করবে৷ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৯ সালে হাইকোর্টের আদেশে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রথম তালিকা তৈরি করে৷ ওই তালিকায় নদীর দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০ জন৷ এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে, যা মোট নদী দখলকারীর ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ৷ ২০২০ সালের তালিকায় দখলদার বেড়ে হয় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন৷ তবে ওই তালিকায় সব জেলার তথ্য তখন পাওয়া যায়নি৷ এরপর আর তালিকা নিয়ে কাজ হয়নি৷ উল্টো তালিকা নিয়ে নানা কাহিনি চলছে৷

২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে ওই তালিকার তথ্যই জানিয়ে বলেন, তালিকা ধরে উচ্ছেদ অভিযান চলছে ৷ তিনি সংসদকে জানান, তখন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী ২১ হাজার ৪৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে ৭২৩.৬২ একর জমি৷

এর মধ্যে ঢাকা নদী বন্দরে ১৬ হাজার ৪২৪টি, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে চার হাজার ৭৬৯টি, বরিশাল নদী বন্দরে ১৪১টি, আশুগঞ্জে ৫০টি এবং নওয়াপাড়া নদী বন্দর থেকে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ সারা দেশে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবর রহমান হাওলাদার জানান, ‘‘নদী যারা দখল করেন, তারা প্রধানত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি৷ সাধারণ মানুষ নদী দখল করে না৷ আর ওই প্রভাবশালীরাই নানা কৌশলে দখল বহাল রাখতে চায়৷ ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে আমি একাধিক দখলদার পেয়েছি যারা সংসদ সদস্য৷’’

যারা নদী দখল করেন তারা প্রধানত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি: মজিবর রহমান হাওলাদার

This browser does not support the audio element.

আর এই দখল উচ্ছেদ করার প্রধান দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের৷ আইনে আরো ১৭ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে ৷ তারা সেটা না করে দখলদারদের সহায়তা করে৷

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল ইয়ার্স অ্যাসেসিয়েশন (বেলা)-র প্রধান সৈয়দা রিজওয়না হাসান বলেন, ‘‘হাইকোর্ট নদী রক্ষা কমিশনকে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করার একটি পরিকল্পনা জমা দিতেও বলেছিলেন৷ কিন্তু সেটা তারা এখনো দেয়নি৷’’

তিনি জানান, ‘‘সর্বশেষ যে ৪৮টি নদীর দখদলারদের যে তালিকা করা হয়েছে সেটা নদীর প্রবাহ ধরে করা হয়েছে৷ কিন্তু এখন সেটা সিএস খতিয়ান দেখে করা হচ্ছে৷ আর এই কারণে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না৷’’

তার কথা, ‘‘হাইকোর্টের আদেশ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারছে না৷ আর ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে যোগশাজশ করেই নদী দখল করা হয়৷ ফলে দখলদারদের নামে রেকর্ড হয়েছে৷ তারা খাজনা দিয়েছে৷ আর বর্তমান নদী রক্ষা কমিশন দিকপালহীন৷ এইসব কারণে দখলদারদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না, দখল আরো বাড়ছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘দখল উচ্ছেদের সঙ্গে আইনে ফৌজদারী মামলা করারও বিধান আছে৷ কিন্তু এই মামলা হলে সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও আসামি হয়ে যাবেন দখলে সহযোগিতা করার অপরাধে, তাই মামলা হয় না৷’’

বর্তমান নদী রক্ষা কমিশন দিকপালহীন: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

This browser does not support the audio element.

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী দখল ফৌজদারী অপরাধ৷ জেলা প্রশাসন এই মামলার উদ্যোগ নিতে পারে৷ আরো যারা দায়িত্বে আছেন তারাও মামলা করতে পারেন৷ উচ্ছেদের সঙ্গে ফৌজদারী মামলা করে নদী দখলদাররা ভয় পাবে৷’’

নদী জীবন্ত সত্তা

২০১৯ সালে হাইকোর্ট তুরাগ নদসহ দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে৷ আর নদীর দখলদারকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণার আদেশ দেয়৷ কিন্তু এইসব ঘোষণার বাস্তব কোনো প্রতিফলন নেই৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পর এখন নদী জীবন্ত ব্যক্তির অধিকার ও আইনগত প্রটেকশন পাবে৷ কিন্তু সেজন্য তো আইন করতে হবে৷ জীবনহানি বা ক্ষতির যে অপরাধ সেই অপরাধে দায়ী করতে হলে আইন প্রয়োজন৷ কিন্তু সেই আইন করার কোনো উদ্যোগ নেই৷ আদালতের নির্দেশনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই৷’’

‘‘আর নদী দখলদারদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য করার যে আদেশ তা আপিল বিভাগে গিয়ে পর্যবেক্ষণ হয়ে গেছে৷ তারপরও সরকার চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ আইন করতে পারে,’’ বলে মনে করেন তিনি৷ তার  কথা, ‘‘নদী কমিশন যে তালিকা করেছে, সেটা রাষ্ট্রপতিকেও দেয়া হয়েছে৷ আদালতেও আছে৷ তাই এই তালিকা ধরেই কাজ করা যায়৷ কিন্তু ২০১৯-২০ সালের পর যেন সব কিছু ঝিমিয়ে পড়েছে৷ এখন আর আমরা উচ্ছেদের খবরও পাই না৷’’

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিতে পারে ঋণ খেলাপিদের মতো৷ নদী রক্ষা কমিশনের সহায়তা নিতে পারে৷ তার তালিকা যদি ওয়েবসাইটে থাকে, তাহলে দখলদার কারা মানুষ তাদের নাম জানবে৷ এটা একটি সামাজিক চাপ সৃষ্টি করবে৷’’

নদী রক্ষা কমিশন ঝিমিয়ে গেছে

রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘‘নদী দখল এখন সারাদেশে৷ আগে ঢাকা এবং বড় শহরের আশপাশের নদী দখল হতো৷ এখন প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়ও নদী দখল হচ্ছে৷ আর দখলদাররা সবাই প্রভাবশালী৷ তারা ব্যবসায়ী অথবা রাজনৈতিক নেতা৷ প্রশাসনের সহায়তায় তারা দখল করেন৷ ফলে তাদের থামানো যায় না৷ আর নদী রক্ষা কমিশন সুপারিশ করতে পারে৷ তারা সরাসরি উচ্ছেদ করতে পারে না৷ আইনে তাদের সীমবদ্ধতা আছে৷ তাদের আরো শক্তিশালী করা দরকার৷ লোকবল দেয়া দরকার৷’’

নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোঙরের সভাপতি সুমন শামস অভিযোগ করেন, ‘‘এখনকার কশিমন অনেকটাই নদী দখলদারদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে৷ আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সংগঠনের চারজনকে বাদ দিয়েছি নদী দখলদারদের সহযোগী হওয়ার কারণে৷ কিন্তু তাদের নদী কমিশন আবার জেলা কমিটিতে জায়গা দিয়েছে৷’’

তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এখন নদী রক্ষা কমিশন যারা নদী নিয়ে কাজ করেন তাদের সহ্য করতে পারে না৷ মনে হয় তারা নদী রক্ষা নয়, অন্য কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে৷’’

মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘নদী রক্ষা কমিশনকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে সেটা ঠিকমতো প্রয়োগ করলেও অনেক কাজ হয়৷ আমাদের সময় হাইকোর্ট আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে৷ আইনজীবীরা করেছেন, পরিবেশ ও নদী রক্ষায় যারা কাজ করেন, তারা সহযোগিতা করেছেন৷ আসল কথা হলো, যদি কমিশনের মধ্যে সমস্যা থাকে, তাহলে তো কাজ ঠিকমতো হবে না৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ