নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট৷ ফলে এখন থেকে নদী দখল, ভরাট, নদী দূষণ ফৌজাদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
বিজ্ঞাপন
আইনজীবীরা বলছেন, ‘‘এখন মানুষ হত্যা করলে যে বিচার, নদী হত্যা করলেও সেই বিচার হবে৷ তার আগে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে আইন পরিবর্তন করতে হবে৷''
তুরাগ নদী নিয়ে করা একটি রিটের রায় দেয়া হয় গত ৩ ফেব্রুয়ারি৷ সোমবার এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়৷ এতে স্পষ্ট হয়েছে যে শুধু তুরাগ নয় দেশের সব নদ-নদীকেই জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে৷ রায় বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ হাইকোর্ট চায় রায়টি যেন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পাঠানো হোক৷
তুরাগ নদী নিয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ'-এর করা এক রিটে এই রায় দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ৷
হাইকোর্ট যে ১৭ দফা আদেশ দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো:
১. সরকারকে নদী দখল ও দূষণকারীদের একটি তালিকা করে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে৷
২. নদী দখল ও দূষণকারীদের নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে৷
৩. বাংলাদেশ ব্যাংক নোটিশ জারি করে সব ব্যংককে নদী দখল ও দূষণকারীদের ঋণ দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে৷
৩. নদী দখল ও দূষণের জন্য দায়ীদের অর্থেই নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে৷
৪. নদী ও জলাধার সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে নদী কমিশনের ছাড়পত্র লাগবে৷
৫. নদী রক্ষায় জাতীয় নদী কমিশন সব নদীর আইনগত অভিভাবক৷
দখল, ভরাট বা দূষণসহ নদীর বিরুদ্ধে অপরাধ ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে: মঞ্জিল মোরসেদ
রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই রায়ে নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা স্বীকৃতি দেয়ায় নদীর বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো৷ আর আদালত যে ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছে তা ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘দখল, ভরাট বা দূষণসহ নদীর বিরুদ্ধে যে-কোনো ধরনের অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ নদীর অস্তিত্ব বিনাশ করা নদী হত্যার শামিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ এজন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করতে বলেছেন আদালত৷''
নদীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে দখলদার ও দূষণকারীদেরই টাকা দিতে হবে:শেখ রোকন
রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘‘হাইকোর্টের এই রায়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, নদী কমিশনকে এখন থেকে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রনালয়, অধিদপ্তর সবাই সহায়তা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য৷ আগে এই ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না৷আর এটি ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের অধীনে একটি কমিশন৷ আরো একটি বিষয় হলো, আমরা সাধারণভাবে দেখি সরকার বা জনগণের টাকায় নদীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়৷ এখন দখলদার ও দূষণকারীদেরই ওই কাজে টাকা দিতে হবে৷''
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফর্মেশন সার্ভিসেস(সিইজিআইএস)-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলদেশে এখন নদীর সংখ্যা ৪৪৫টি৷ আর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদী ৪০৫টি৷ রিভারাইন পিপল জানায়, নদীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি৷ শেখ রোকন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অন্তত ৩৮টি বড় নদী দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত৷ আর এই দখল দূষণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা রাজনৈতিক এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী৷ রজনৈতিক ক্ষমতার বদল হলেও দখল অব্যাহত থাকে৷ আর সরকারিভাবে যাদের এই নদীগুলো রক্ষা করার কথা, তারা দখলে সহায়তা করে৷''
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘এর আগে ভারতে গঙ্গাকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ ইউরোপেও কিছু নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়৷ বাংলাদেশেও করা হলো৷ মানুষ হত্যা করলে যে বিচার, এখন নদী হত্যা করলেও সেই অপরাধে বিচার হবে৷ এজন্য আইন পরিবর্তন করতে হবে৷ আদালত এ কারণেই আইন পরিবর্তনের কথা বলেছেন৷''
বুড়িগঙ্গায় দূষণ: শত্রু কারা কারা?
২২শে মার্চ ছিল বিশ্ব পানি দিবস৷ সবার কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই দিনটি উদযাপিত হয়৷ অথচ বিশ্বে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে পানির সরবরাহ৷ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবেশ দূষণ৷ ঠিক যেমনটা ঘটছে বুড়িগঙ্গা নদীতে...
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী
একসময় মহানগরীর প্রাণ হিসেবে গণ্য হতো বুড়িগঙ্গা নদী৷ কিন্তু এই শহরের শিল্প আর মানব বর্জ্য সরাসরি এ নদীতে নির্গমনের ফলে নদীটি পানি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে৷ এই ছবিটি শহরের বাবুবাজার সেতু থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নোংরা গন্ধযুক্ত পানি
ব্যবহারের অনুপোযোগী হলেও মানুষের হাত-পা বাঁধা৷ তাই বুড়িগঙ্গা নদীর নোংরা, গন্ধযুক্ত পানির ওপর দিয়েই খেয়াপার হচ্ছেন কর্মজীবী মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব মানুষের বাস
ঢাকার এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া কম হওয়ায় নদীর ওপারের কেরানীগঞ্জ এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি৷ ছবিটি সদরঘাট এলাকা থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ
বুড়িগঙ্গা আজ যেন সত্যিই বুড়ি হয়ে গেছে৷ নদীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন কুচকুচে কালো, আর দুর্গন্ধযুক্ত৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণের কারণে বেড়েছে ঘনত্ব
বুড়িগঙ্গার দূষিত পানির উপর দিয়ে জাহাজ চলার পরের দৃশ্য এটি৷ কি ভয়াবহ! আসলে দূষণের কারণে পানির ঘনত্ব বেড়ে গেছে বুড়িগঙ্গার৷
ছবি: DW/M. Mamun
নদীতে লঞ্চ চলাচল
দূষণের এই ভয়াবহ মাত্রার পরও বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে চলছে লঞ্চ৷ জিনিস-পত্র পারাপার তো বটেই, নদী পথে যে এখনও পার হচ্ছে মানুষ৷ ছবিটি কামরাঙ্গীরচর থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাসায়নিকের বস্তা পরিষ্কার
বুড়িগঙ্গার পানিতে রাসায়নিকের বস্তা পরিষ্কার করছেন শ্রমিকরা৷ তাঁদের কি আর কোনো উপায় নেই? তাঁরা কি আদৌ জানেন এর পরিবেশগত প্রভাব? সরকারই বা নিরব কেন?
ছবি: DW/M. Mamun
ধোপাদেরও প্রয়োজন নদী
বুড়িগঙ্গার দূষিত জলেই কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত ধোপারা৷ এ সব কাপড়ের বেশিরভাগই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত বিছানার চাদর, ডাক্তারদের অ্যাপ্রন, অপারেশন থিয়েটার বা ওটি-তে পড়ার ড্রেস ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ধোয়া কাপড়
বুড়িগঙ্গা নদীর দূষিত জলে ধোয়া কাপড় এবার মেলে দেওয়া হয়েছে৷ নদীর পাড়েই শুকানো হচ্ছে এগুলি৷ ছবিটি কামরাঙ্গীরচর থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্জ্য মিশছে সরাসরি
ঢাকা শহরের সুয়ারেজের লাইন থেকে সরাসরি বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গা নদীর জলে৷ এমন দশা চলতে থাকলে অচিরেই যে অন্ধকার নেমে আসবে – তা বলাই বাহুল্য৷ শহরের বাবুবাজার সেতুর নীচ থেকে তোলা এ ছবিটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারি
বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারি শিল্পর বর্জ্য৷ ঢাকার হাজারীবাগে বেশ কিছু ট্যানারি শিল্প থাকলেও কারুরই নেই বর্জ্য শোধনাগার৷ তাই এ সব ট্যানারির রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য সরাসরি গিয়ে মিলে বুড়িগঙ্গায়৷ গত এক যুগ ধরে ঢাকার বাইরে ট্যানারি শিল্পের জন্য আলাদা জায়গা দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ট্যানারি মালিরা কারখানাগুলো স্থানান্তর করছেন না৷
ছবি: DW/M. Mamun
শুধু দূষণই নয়...
শুধু দূষণেই থেমে নেই বুড়িগঙ্গা৷ আছে দখলও৷ দূষণ আর দখলে থেমে যেতে বসেছে বুড়িগঙ্গার গতিপথ৷ কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গা যেন এখন মরা খাল!
ছবি: DW/M. Mamun
আর এক শত্রু প্লাস্টিক
শিল্প আর মানব বর্জ্য ছাড়াও বুড়িগঙ্গা দূষণের আরেক অংশীদার প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য৷ প্রতিদিন প্রচুর প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য মিশছে বুড়িঙ্গার জলে৷ এ ছবিটি বাদামতলী থেকে তোলা৷