নবীনদের মতো প্রবীণরাও মেতে বিশ্বকাপে৷ আর্জেন্টিনার জয়ের অপেক্ষায় প্রহর গোনা চলছে কলকাতার বৃদ্ধাশ্রমেও৷ আবার ফ্রান্সের জয়ের প্রতীক্ষা সাবেক ফরাসি উপনিবেশে৷ কেউ কেউ বিমর্ষ ব্রাজিল আগেই বিদায় নেওয়ায়৷
বিজ্ঞাপন
কলকাতা বলতে একসময় বোঝাতো হলুদ-সবুজের শহর৷ ব্রাজিলের ফুটবলে সম্মোহিত ছিল বাঙালি৷ ১৯৮৬ সালে প্রথম দূরদর্শনে সরাসরি দেখা গিয়েছিল বিশ্বকাপ৷ সে বছরই আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন৷ ব্রাজিলের একাধিপত্যে ভাগ বসায় নীল-সাদা ব্রিগেড৷ তারপর আর্জেন্টিনা আর বিশ্বকাপ জেতেনি৷ তাই আরো একবার ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা ফাইনালে নামার আগে কলকাতায় উত্তেজনা তুঙ্গে৷
নবীনরা বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মেসির দেশের পতাকায় মুড়ে দিয়েছেন পাড়া৷ দেওয়ালে আঁকা হয়েছে ছবি৷ কালো পিচ রাস্তা থেকে বাসস্ট্যান্ড, বিভিন্ন জায়গায় মারাদোনা ও মেসিকে পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে৷ সেখানে ব্রাজিলের পতাকা এখনো ঝুলছে, কিছুটা যেন বিষণ্ণ হলুদ রং!
নবীন থেকে প্রবীণ, যাদের চুলে পাক ধরেছে, যারা পেলে ও মারাদোনাকে কলকাতার মাঠে খেলতে দেখেছেন, তারাও এখন মেসি ভক্ত৷ কেষ্টপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে হইহই করে আর্জেন্টিনার অধিনায়কের প্রতি শুভেচ্ছায় কেক কাটা হয়েছে৷
জাগরণী ফাউন্ডেশন-এর ‘নতুন ঘর' বৃদ্ধ আবাসে থাকেন ভবঘুরে বৃদ্ধারা৷ তারা পরে নিয়েছেন নীল-সাদা জার্সি৷ খুকুমণি পাল, মাধবী বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্ম রায়, মালতী ঘোষ, অর্চনা রায়ের কাছে সুদূর আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি ‘ঘরের ছেলে'৷ কেক কাটা, মিষ্টিমুখের পর আবাসিক বীণা বারুলি বলেন, ‘‘মেসি যে বিশ্বের সেরা ফুটবলার, তা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ আমরা রোববার জয়ের অপেক্ষায় আছি৷ মেসির হাতে কাপ দেখতে চাই৷''
এই বৃদ্ধাশ্রমের সম্পাদক অসীম রায়চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অল ইন্ডিয়া হিউম্যান রাইটস সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল৷ তারা এখানে এসে আবাসিকদের সঙ্গে বিশ্বকাপের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে৷''
‘অল ইন্ডিয়া হিউম্যান রাইটস সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল’
দমদমের ‘স্বপ্ননীড়' বৃদ্ধাবাসের আবাসিকরা মাসভর ফুটবল দেখছেন৷ এখানকার কর্ণধার সঞ্জয় শূর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা আবাসিকরাও উৎসাহী৷ সব ঘরে টিভির ব্যবস্থা রয়েছে৷ কেউ কেউ মাঝরাত পর্যন্ত খেলা দেখছেন৷ ওরা চাইছেন মেসির হাতে উঠুক বিশ্বকাপ৷''
আর্জেন্টিনার সমর্থকরা যখন ফাইনালের আগেই খুশিতে ভাসছেন, তখন চির প্রতিদ্বন্দ্বীর শিবিরে হতাশা৷ তিন দশক ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গ্যালারিতে লজেন্স বিক্রি করেন যমুনা দাস৷ ৬০ ছুঁইছুঁই যমুনা লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে ‘লজেন্স দিদি'৷ ব্রাজিলের বিদায়ের পর বিশ্বকাপ দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি৷ যমুনার কথায়, ‘মনটাই ভেঙে গিয়েছে এবার৷ ব্রাজিল না থাকায় খেলা দেখার উৎসাহ পাচ্ছি না৷ তবে আমি মেসিকে কলকাতায় দেখেছি, ভাল লেগেছিল৷ কিন্তু আমি ব্রাজিলেরই সমর্থক৷''
আর এক মহাতারকা রোনাল্ডোও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছেন৷ এ বার রাস্তাঘাটে পর্তুগালের পতাকার সঙ্গে রোনাল্ডোর ছবিও কিছু দেখা গিয়েছে৷ যদিও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের আবেগের পাশে তা নগণ্য৷ আর ফ্রান্স? না, দূরবিন দিয়েও কেউ ফরাসি পতাকা বা এমবাপে-গ্রিজম্যানদের ছবি দেখাতে পারবেন না৷
‘গোটা চন্দননগর ফ্রান্সের জয় চাইছে’
কলকাতা থেকে ৫০ কিমি দূরের এক শহরে গেলে অবশ্য ছবিটা পাল্টে যায়৷ হুগলি নদীর পাড়ে চন্দননগর একসময় ফরাসিদের উপনিবেশ ছিল৷ সেখানকার একটা বড় অংশের মানুষ রোববারের ফাইনালে ছবি ও কবিতার দেশের জয় চাইছেন৷ ফ্রান্সের পতাকার রঙে সেজেছে শহর৷
চন্দননগরের আমজনতার সঙ্গে এক ইউরোপীয় বধূও ফ্রান্সের জয়ের জন্য মুখিয়ে আছেন৷ ইউনেস্কোর কাজে ফ্রান্স থেকে চন্দননগর এসে ঘর বেঁধেছেন নেলিনা মণ্ডল৷ স্বামী প্রশান্তের সঙ্গে এখানেই আলাপ৷ নেলিনা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বেলজিয়ামের মেয়ে৷ নেদারল্যান্ডসে বড় হয়েছি৷ ১৯৮২-৮৮ সালে উচ্চশিক্ষা ও চাকরি প্যারিসে৷ রবিবার জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখব৷ আমি কেন, গোটা চন্দননগর ফ্রান্সের জয় চাইছে৷''
বীণা না নেলিনা, কার মুখে হাসি ফুটবে? শুরু হয়ে গিয়েছে কাউন্টডাউন৷
কলকাতার ফুটবল, তিন প্রধান এবং আবেগ
ফিফার নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ভারতে ঘরোয়া ফুটবলের আসর জমজমাট। চলছে ডুরান্ড কাপ। তিন প্রধান খেলছে সেখানে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বহুদিন পর
করোনার জন্য কলকাতার মাঠে দুই বছর প্রায় বলই পড়েনি। কলকাতার ফুটবল লিগ হয়নি। মাঠভর্তি দর্শক, প্রিয় ক্লাব ঘিরে তাদের উন্মাদনা কিছুই দেখা যায়নি। কিন্তু এবার ছবিটা আলাদা। ভারতের সবচেয়ে পুরনো টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপ দিয়ে শুরু হয়েছে ফুটবল মরসুম। তিন প্রধানের খেলা কলকাতায় হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে সেই পুরনো ছবি। তিন প্রধানই এবার ভালো দল গড়েছে। উপরের ছবিটি মোহনবাগানের প্র্যাকটিসের।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মহামেডানের জয়
মহামেডান এখনো ভারতের প্রধান প্রতিযোগিতা আইএসএলে নেই। তারা আই লিগ খেলে। তবে এবার তারা শক্তিশালী টিম গড়েছে। অনেকদিন পরে টিম যথেষ্ট ভালো খেলছে। পরপর দুইটি ম্যাচে আইএসএলের টিম এফসি গোয়া এবং জামশেদপুর এফসি-কে হারিয়েছে মহামেডান।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নামী মুখ ছাড়াই
মহামেডানে সেই অর্থে নামি বা দামি ফুটবলার নেই। দলের কর্মকর্তারা নামের পিছনে না ছুটে ভালো প্লেয়ার আনার চেষ্টা করেছেন। তার সুফলও পাচ্ছেন। টিম দ্রুতগতির ফুটবল খেলছে। আর মহামেডানের রাশিয়ান কোচ আন্দ্রে চার্নিশভ টিমের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হার মোহনবাগানের
মোহনবাগানের নাম এখন এটিকে মোহনবাগান। এবার তারা রীতিমত শক্তিশালী দল গড়েছে। নামি বিদেশিদের নিয়ে এসেছে। সঙ্গে ভারতীয় ব্রিগেড তো আছেই। আছেন স্প্যানিশ কোচ জুয়ান ফেরান্দো। কিন্তু প্রথম ম্যাচে গতবারই প্রথম আই লিগ খেলা রাজস্থান এফসি-র কাছে হেরে গেছে মোহনবাগান।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পোগবার দাদা
এটিকে মোহনবাগান এবার টিমে নিয়েছে ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার পল পোগবার দাদা ফ্লোরেন্টিন পোগবাকে। রক্ষণের এই তারকাকে নিয়ে এটিকে মোহনবাগানের সমর্থকদের প্রচুর ভরসা ছিল। কিন্তু পোগবা প্রথম খেলায় হতাশ করেছেন। প্রথম খেলায় তিনটি গোল খেয়েছে মোহনবাগান। ফলে তারা রক্ষণ নিয়ে চিন্তায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ইস্টবেঙ্গলের পরে শুরু
বিনিয়োগ সমস্যায় এবারও অনেক পরে টিম গড়েছে ইস্টবেঙ্গল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে তারা ইমামিকে বিনিয়োগকারী হিসাবে পেয়েছে। অনেক সময় নিয়ে ইমামির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ইস্টবেঙ্গলের। তারপর তারা দলগঠন করেছে। আইএসএলে খেলে যাওয়া বিদেশিদের উপরই ভরসা রেখেছে ইস্টবেঙ্গল। আর নতুন কোচ হয়েছেন ভারতীয় দলের সাবেক কোচ স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেমন টিম ইস্টবেঙ্গলের
ইমামি ইস্টবেঙ্গলের টিমে পাঁচ বিদেশির মধ্যে তিনজন ব্রাজিলের। অ্যালেক্স লিমা, এলিয়ান্দ্রো স্যান্টোস ও ক্লেটন সিলভা। সোমবার প্রথম খেলতে নামার আগে কোচ কনস্ট্যানটাইন বলেছেন, ডুরান্ড কাপকে তিনি দেখছেন প্রস্তুতির ম্যাচ খেলার সুযোগ হিসাবে। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার ইস্টবেঙ্গলের ভারতীয় খেলোয়াড়দের মান ভালো বলে মনে করা হচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ডার্বি আসছে
আর কয়েকদিন পরেই ২৮ অগাস্ট ডার্বি ম্যাচ। মুখোমুখি হবে ইমামি ইস্টবেঙ্গল ও এটিকে মোহনবাগান। গত দুই বছর ডার্বিতে বারবার জিতেছে মোহনবাগান। এবার মরশুমের শুরুর ডার্বি ঘিরে দুই দলের সমর্থকরা উত্তেজনায় ফুটছেন। শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। বহুদিন পরে কলকাতায় ডার্বির উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শুধু তিন প্রধানই নয়
কলকাতার ফুটবল মানে শুধু এই তিন প্রধানই নয়, আছে অসংখ্য ক্লাব। কয়েকটি ক্লাব খুবই পুরনো। যেমন এরিয়ান ক্লাব। ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মাঠ শেয়ার করে এরিয়ান। কলকাতা লিগে এরিয়ান রীতিমতো শক্তিশালী দল।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিএনআর ক্লাব
এই ক্লাবের জন্ম ১৯২৯ সালে। আইএফএ শিল্ড, রোবার্স জেতা এই ক্লাবেরও দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এখনো কলকাতা লিগে বিএনআর বড় শক্তি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ময়দানের ফুটবল
কলকাতা ময়দানে বিভিন্ন ডিভিশনে খেলা ক্লাবের সংখ্যা কয়েকশ। তাদের অনেকেরই প্র্যাকটিস হয় এরকম খোলা মাঠে। গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার যুবক ময়দানে আসেন বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কেউ পারেন। কেউ হারিয়ে যান। কিন্তু ফুটবল ও ময়দানের আকর্ষণ কমে না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ময়দানের ক্যান্টিন
ছোট-বড় যে দলই হোক না কেন, কঠোর অনুশীলন করে। কিন্তু তারপর সব প্লেয়ারই যে পুষ্টিকর খাবার পায়, এমন নয়। অনেকের ভরসা ময়দানের ক্যান্টিনে স্টু ও পাউরুটি। কেউ কেউ শুধু কাটা ফল খান। কেউ বা শুকনো রুটির সঙ্গে তরকারি। দিনের পর দিন তাই খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তারা লড়াই করে যায় বড় ফুটবলার হওয়ার জন্য।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চাইনিজ ওয়াল
ময়দানে গোষ্ঠ পালের স্ট্যাচু। গোষ্ঠ পালের নাম ছিল চাইনিজ ওয়াল। তার মূর্তি ময়দানের বিশেষ স্মারক। এর পাশেই ময়দানের বিখ্যাত বটতলা। সত্তর-আশির দশকে এখানে ফুটবালর সই করা নিয়ে উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান একে অপরের ফুটবলার ছিনিয়ে নিত। তাদের খেলা দেখতে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মাঠ ভরিয়ে দিতেন। সে সময় আর নেই। তবুও কলকাতা ময়দানের আবেগ শেষ হয়ে যায়নি।