আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন আইএসএস-এ যাওয়া নভচারীদের কাজের প্রয়োজনে মহাকাশযানের বাইরে যেতে হয়৷ স্পেসওয়াক-এর মাধ্যমে সেটি করেন তারা৷
বিজ্ঞাপন
সেজন্য তাদের বিশেষ স্যুট পরতে হয়৷ কারণ, আইএসএস-এর বাইরে হাঁটা যেমন কঠিন, তেমন বিপজ্জনক৷ স্টেশনটি যে উচ্চতায় ঘোরে সেখানে অনেক ঠাণ্ডা৷ এছাড়া কোনো বাতাসও নেই৷ মাত্র ৩০ সেকেন্ড পরই মানুষ মরে যাওয়ার কথা৷
শুধুমাত্র বিশেষ স্যুট পরেই নভচারীদের বেঁচে থাকা সম্ভব৷ স্যুটটি দেখতে অনেকটা ছোট মহাকাশযানের মতো৷
পিঠে থাকা ব্যাগ নভচারীদের শ্বাস নেওয়ার বাতাস দেয়৷ আর কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দেয়৷
স্যুটে কয়েকটি স্তর থাকে যেন গ্যাস ঢুকতে বা বেরোতে না পারে, আর অতিরিক্ত চাপও যেন সহ্য করতে পারে৷
বাইরের স্তরটি অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপ দেওয়া অগ্নি-প্রতিরোধী কেভলার তন্তু দিয়ে তৈরি৷ মাইক্রো-মিটিওরাইট ও সৌর বিকিরণ থেকে নভচারীদের রক্ষা করে এই স্যুট৷
নভচারীরা বিশেষ পোশাক পরেন যার সঙ্গে টিউব লাগানো থাকে৷ এই টিউব দিয়ে ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত হওয়ায় নভচারীরা অতিরিক্ত তাপ থেকে রক্ষা পান৷
আইএসএস-এ যাওয়ার আগে নভচারীরা বিশেষ সুইমিংপুলে ট্রেনিং নেন৷ এইসময় ডাইভারদের মতো তাদের ১০০ কেজি ওজনের স্যুটের সঙ্গে আরও ওজন লাগানো থাকে, যেটি তাদের ভেসে থাকতে সহায়তা করে৷ অর্থাৎ মহাকাশের অবস্থা তৈরি করা হয়৷
নভচারীদের বিশেষ স্পেসস্যুট
03:29
আইএসএস-এ ওজনহীন পরিবেশ থাকে৷ কারণ, এটি এত দ্রুত পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে যে, কেন্দ্রাতিগ বল ও মাধ্যাকর্ষণ একে অপরের ভারসাম্য বজায় রাখে৷ প্রতি সেকেন্ডে এটি সাত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে!
নভচারীরাও একই গতিতে চলতে থাকেন৷ কিন্তু তারা সেটি টের পান না৷
স্টেশনের বাইরে নভচারীরা তাদের নিজস্ব অরবিটে থাকেন৷ ছোট ধাক্কা বা নড়াচড়ার কারণে অরবিট পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে৷ সেটি হলে তাদের দূরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যেমনটা এতদিন নভচারীদের হারিয়ে ফেলা বিভিন্ন উপকরণের ক্ষেত্রে হয়েছে৷
সেটি হলে নভচারীদের পক্ষে নিজে নিজে ফিরে আসা সম্ভব নয়৷ সে কারণে মহাকাশযানের সঙ্গে তাদের সবসময় আটকে থাকতে হয়৷
নাসা ১৯৮৪ সালে বিশেষ ব্যাকপ্যাক পরীক্ষা করেছিল৷ বিভিন্ন কাজে নভচারীরা যেন মহাকাশযান থেকে দূরে যেতে পারেন সেজন্য এর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল৷ জরুরি পরিস্থিতিতে পড়লে নভচারীরা তাদের অবস্থান স্থিতিশীল করতে থ্রাস্টার চালু করে মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারেন৷
আইএসএস-এর বাইরে কাজ করার সময় নভচারীরা দুটি শিকল দিয়ে স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন৷ শিকল ব্যবহার করে তারা নড়াচড়া করতে পারেন৷ তবে স্থান পরিবর্তনের সময় অন্তত একটি শিকলের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হয়৷
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএসে নভচারীদের জীবন কেমন? কীভাবে তারা টয়লেট করেন? তাদের কি ‘যৌনজীবন’ থাকে? কেমন বেতন পান তারা? এসব প্রশ্নের উত্তর থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: NASA
অ্যালকোহল নিষিদ্ধ
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস-এ নভচারীদের জন্য অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ৷ কারণ অ্যালকোহলের মূল উপাদান ইথানলের কারণে কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ এমনকি অ্যালকোহল আছে এমন মাউথওয়াশ কিংবা আফটারশেভ লোশনও তারা ব্যবহার করতে পারেন না৷ ছবিতে দুজন নভচারীকে ‘ভদকা টিউব’ হাতে দেখা গেলেও তার ভেতরে আসলে আছে বিট স্যুপ৷
ছবি: NASA
মহাকাশে মৃত্যু
১৯৬৭ সালে মার্কিন এক নভচারী ৫০ মাইল উপরে স্পেসপ্লেন চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটে মারা যান৷ ১৯৬৭ ও ১৯৭১ সালে মারা যান চার সোভিয়েত নভচারী৷ এরপর ১৯৮৩ সালে চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল উড্ডয়নের ৭৩ সেকেণ্ডের মাথায় বিস্ফোরিত হলে সাতজন মারা গিয়েছিল৷ ২০০৩ সালে কলোম্বিয়া স্পেস শাটল পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঢোকার পর বিস্ফোরিত হলে তখনও সাতজন মারা গিয়েছিলেন৷
ছবি: Thom Baur/AP/picture alliance
নভচারীরা টয়লেট করেন কীভাবে?
২০০০ সালে একটি স্পেস টয়লেটের নকশা করা হয়েছিল৷ সেখানে টয়লেট সিটে বসার পর ফিতা দিয়ে উরু বাঁধার ব্যবস্থা ছিল৷ কিন্তু সেটা তেমন ভালো কাজ করেনি৷ এরপর ২০১৮ সালে নাসা ভ্যাকুয়াম স্টাইলের এক টয়লেট বের করে যেখানে বসার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য টেনে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাথরুমের বেশিরভাগ বর্জ্যই পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ তবে প্রস্রাব রিসাইকেল করে খাওয়ার পানিতে পরিণত করা হয়৷ ভিডিও দেখতে উপরের + চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Long Wei/Costfoto/picture alliance
নভচারীদের বেতন কত?
১৯৬৯ সালে চাঁদে যাওয়া অ্যাপোলো ১১ মিশনের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং৷ তার বেতন ছিল বছরে ২৭ হাজার ৪০১ ডলার - বর্তমানের হিসেবে সেটা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ নয় হাজার ১২২ ডলারে৷ বাংলাদেশি টাকায় সেটা বছরে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা৷ বর্তমানে যারা নাসায় নভচারী হিসেবে আছেন তাদের বেতন বছরে ৫৭ লাখ থেকে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকার মতো৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বেতন ঠিক করা হয়৷
ছবি: NASA
নভচারীরা কি আগে মরেন?
মাথায় তরল জমা, রক্ত কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে বলে আইএসএস থেকে ফেরার পরপর নভচারীদের চেহারা কিছুটা মলিন দেখায়৷ তবে মহাকাশ ভ্রমণের কারণে শরীরের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে কিনা সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ অবশ্য এটা জানা গেছে যে, আপেক্ষিকতার কারণে নভচারীরা পৃথিবীতে কয়েক মিলিসেকেণ্ড তরুণ হয়ে ফেরেন৷
ছবি: Bill Ingalls/NASA/epa/dpa/picture-alliance
মহাকাশে যৌনমিলন?
নাসা বলছে, মহাকাশে এখনও কোনো মানুষ যৌন মিলন করেনি৷ মার্কিন নভচারীরাও এই বিষয়ে কথা বলেননি৷ তবে ১৯৯২ সালে নাসার স্পেস শাটল ‘এন্ডেভার’-এ চড়ে মার্ক লি ও জ্যান ডেভিস দম্পতি আইএসএস-এ গিয়েছিলেন৷ সেটা তাদের হানিমুন ছিল৷ যদিও তাদের অভিজ্ঞতার তথ্য পাওয়া যায় না৷ মাইক্রোগ্র্যাভিটির কারণে নভচারীরা ওজনহীনতা অনুভব করায় তাদের এস্ট্রোজন হরমোন কমে যায়৷ আর এস্ট্রোজন কমের সঙ্গে যৌন মিলনের আকাঙ্খা কমার সম্পর্ক রয়েছে৷
ছবি: Bruce Weaver/AFP/Getty Images
নভচারীরা ঘুমান কীভাবে?
জার্মান নভচারী মাটিয়াস মাওরার দেখাচ্ছেন কীভাবে আইএসএস-এ নভচারীরা ঘুমান৷ দেয়ালের সঙ্গে লেগে থাকা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুমাতে হয় তাদের৷ ফলে ঘুমানোর সময় ভেসে বেড়ানো কিংবা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা৷