অবশেষে বরফ গলেছে। ইরানের নতুন সরকার পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনায় সম্মত হয়েছে। নভেম্বরে আলোচনা হবে।
বিজ্ঞাপন
অ্যামেরিকায় জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরানের সঙ্গে ফের পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা চলছিল। বাইডেন নিজেও একাধিকবার এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইরান তাতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে ইরানের নতুন সরকার আলোচনায় বসতে রাজি হলো। এর ফলে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইরান সরকারের মুখপাত্র বুধবার জানিয়েছেন, নভেম্বরের শেষ দিকে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে তারা রাজি। তবে নির্দিষ্ট তারিখ বুধবার জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে তারিখও জানিয়ে দেওয়া হবে। টুইট করেও সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।
কূটনৈতিক মহলের ধারণা, ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নতুন করে পরমাণু চুক্তিতে অংশ নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। তার আগের প্রেসিডেন্টের চেয়ে এ বিষয়ে তিনি অনেক বেশি সক্রিয় বলে মনে করা হচ্ছে।
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
গত এপ্রিল মাস থেকে অ্যামেরিকা, যুক্তরাজ্য-সহ বিশ্বের ছয়টি উন্নত রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত ইরান আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। ভিয়েনায় এ নিয়ে ইরানের প্রতিনিধির সঙ্গে অন্য দেশগুলির মোট ছয় বার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি। বরং দেশের ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়িয়েছে ইরান। জাতিসংঘকে পরমাণু পরীক্ষাগারের ছবি পাঠানোও বন্ধ করেছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান যেভাবে ইউরেনিয়াম মজুত করছে, তাতে তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই ইরানের বর্তমান অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে অ্যামেরিকা। তবে একইসঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দ্রুত পরমাণু চুক্তির আলোচনা শেষ করতে হবে। ইরান এ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করার চেষ্টা করলে অ্যামেরিকা অন্যরকম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তপ ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যান। ইরানের উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন তিনি। ফলে ইরানও চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর থেকেই পরমাণু শক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে তীব্র বিরোধ শুরু হয় অ্যামেরিকার। অবশেষে সেই বিরোধ কাটার সামান্য আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।