নরওয়ের হামলার পর ইউরোপে উগ্র-দক্ষিণপন্থী কার্যকলাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা
৩০ জুলাই ২০১১ইউরোপে ‘রাইট উইং পপুলিস্ট'দের প্রভাব
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য উগ্র দক্ষিণপন্থী বা ‘রাইট উইং পপুলিস্ট' গোষ্ঠী ছড়িয়ে রয়েছে৷ আঞ্চলিক স্তরে তাদের অবস্থান যাই হোক না কেন, কয়েকটি বিষয়ে তাদের মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ যেমন তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধী৷ বিদেশি অভিবাসীদের একেবারেই পছন্দ করে না, মুসলিমদের প্রতি তাদের মনে প্রবল বিদ্বেষ জমে আছে৷ যেমন ফ্রান্সের ‘ন্যাশানাল ফ্রন্ট' অভিবাসী ও মুসলিমদের দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করে৷ তাদের মতে, অতীতে ইউরোপে যখনই এমনটা দেখা গেছে, গোটা মহাদেশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেছে৷ আশঙ্কার কথা হলো, এই ধরণের বুলি ফ্রান্সের অনেক মানুষেরই মনে ধরছে৷ ফলে ‘ফ্রঁ নাসিওনাল'এর প্রতি সমর্থনও বাড়ছে৷ দলের নেত্রী মারিন ল্য পেন ইটালির ‘নর্দার্ন লিগ' ও অস্ট্রিয়ার ‘ফ্রিডম পার্টি'র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন৷ আদর্শগতভাবে তারা একই পথের পথিক৷ তারাও বহু বছর ধরে ইউরোপে বিদেশিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ক্ষমতায় এলেই বিপদ
ইউরোপের পূর্বাংশেও এমন প্রবণতা বিরল নয়৷ ‘হাঙ্গেরিয়ান সিভিল ইউনিয়ন' দল এমনকি দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে বেশ কিছু বিতর্কিত পরিবর্তনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ যেমন জাতীয়তাবাদের গর্বকে নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে৷ সংবাদ মাধ্যমের উপরেও নানা বাধানিষেধ চাপানো হয়েছে৷ ফলে কোনো সাংবাদিক সরকারের নীতির সমালোচনা করলে তাদের চাকরি খোয়াতে হচ্ছে৷
হাঙ্গেরির শাসক মহলে এই প্রবণতার ফলে গোটা ইউরোপে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে ‘হাঙ্গেরিয়ান সিভিল ইউনিয়ন' ক্ষমতায় এসেছে – ফলে তাদের ইচ্ছামতো পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার নিশ্চয় রয়েছে৷ অন্যদিকে তাদের কার্যকলাপ ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷ হাঙ্গেরিকে একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত করে তুলতে সংবিধানে পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে শাসক দল দাবি করলেও ইউরোপ জুড়ে এবিষয়ে গভীর সংশয় রয়েছে৷ যেমন একমাত্র খ্রীষ্টধর্মের ঈশ্বর, খ্রীষ্টধর্মের প্রতি বিশেষ আনুগত্য, জাতি হিসেবে হাঙ্গেরীয়দের বিশেষ মর্যাদা – এমন সব প্রবণতা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইউরোপীয় সত্তার ধারণার একেবারে বিরোধী৷
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার চালচিত্র
ইউরোপের উত্তরাংশে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক প্রবণতা৷ সেখানকার খোলামেলা সমাজ বহুকাল ধরে উদারপন্থী মনোভাবের কারণে প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ ডেনমার্কের জোট সরকারে ‘রাইট উইং পপুলিস্ট' দলের নেত্রী পররাষ্ট্র নীতির দায়িত্বে রয়েছেন৷ তাঁরই উদ্যোগে সেদেশের সীমান্তে আবার নিয়ন্ত্রণ চালু করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডে চলতি বছরের সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী ‘আসল ফিন' দল ১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করেছে৷ দলের নেতা টিমো সোইনি এমন কিছু বিষয়ে নিজের ব়্যাডিকাল ধারণা তুলে ধরে এই সাফল্য পেয়েছেন, যা নিয়ে দেশের মানুষের মনে ভীতি রয়েছে৷ যেমন তিনি পর্তুগালের মতো প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশকে অর্থ দেওয়ার বিরোধী৷ সমকামীদের বিবাহের অধিকার তিনি মেনে নেন নি৷ অভিবাসীদের জন্য ফিনল্যান্ডের দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চান তিনি৷ আপাতত বিরোধী আসনে বসে সরকারকে বিপাকে ফেলছে এই দল৷ ক্ষমতায় এলে তারা যে কী করবে, তার একটা আন্দাজ এখনই পাওয়া যাচ্ছে৷
নেদারল্যান্ডস'এর পরিস্থিতি
নেদারল্যান্ডস'এর পরিস্থিতিও আলাদা নয়৷ সেখানে সংখ্যালঘু সরকার খেয়ার্ট ভিল্ডার্স'এর ‘রাইট উইং পপুলিস্ট' দলের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল৷ ভিল্ডার্স ইসলাম ধর্ম ও কোরআনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করে চলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশ ইসলাম ধর্মের কারণে রসাতলে গেলে আমাকে মুখ খুলতেই হবে৷''
আদালতের এক রায়ের কল্যাণে খেয়ার্ট ভিল্ডার্স'এর মুখ বন্ধ রাখাও সম্ভব নয়৷ মত প্রকাশের অধিকারের ভিত্তিতে অপ্রিয় বিষয় নিয়ে কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন তিনি৷ নেদারল্যান্ডস'এর লেখক হান্স মার্টেন ফান ডেন ব্রিংক বলেন, সমাজের পরিবেশ আগের তুলনায় বদলে গেছে৷ আরও কড়া আইন চালু হয়েছে, অভিবাসীদের প্রতি সহিষ্ণুতা কমে গেছে৷ তিনি আরও বললেন, ‘‘আসলে কিন্তু হল্যান্ডের মানুষ বেশ ভালো আছেন৷ তারা খুবই সন্তুষ্ট এক জাত৷ ব্যক্তিগত জীবনে তারা খুশি৷ ইউরোপের বাকি অংশের তুলনায় এদেশের অর্থনীতির অবস্থাও বেশ ভালো৷ হয়তো ঠিক এই কারণেই এমন অশান্তি দেখা যাচ্ছে৷ কারণ এই মুহূর্তে ভালো থাকলে তবেই তো ভবিষ্যতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে৷''
উগ্র দক্ষিণপন্থীদের কৌশল
এই বিতর্কের ভিত্তিই হলো ভয়, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মনোভাব৷ তখন খোঁজ পড়ে, কাকে এসবের জন্য দায়ী করা যায়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজে দুর্বল শ্রেণীর ঘাড়েই দায় চাপানো হয় – যেমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিদেশি অভিবাসী ইত্যাদি৷ যারা এই মনোভাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখে, তারা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের সমর্থন পায় বলে মনে করেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সবুজ দলের সাংসদ স্ভেন গিগল্ড৷ তিনি বললেন, ‘‘এটা এমন একটা প্রবণতা, যা আমরা জার্মানির আশেপাশের অনেক দেশে দেখতে পাচ্ছি৷ ভাগ্য ভালো, যে জার্মানিতে এমন প্রবণতা নেই৷ এবং রাজনৈতিক স্তরে এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷''
অর্থাৎ এমন সর্বনাশা মতবাদ রুখতে এর প্রতিরোধ করতে হবে৷ কঠিন বিষয়গুলি সম্পর্কে তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে এবং মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর করতে হবে৷ একমাত্র এভাবেই ‘রাইট উইং পপুলিস্ট'দের মোকাবিলা করা সম্ভব৷
প্রতিবেদন: বির্গিট শ্মাইৎসনার/সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারূক