একশরও বেশি মানুষকে পণবন্দি করে নিয়ে গেল নাইজেরিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স। বোকো হারামের সহযোগী সংগঠন এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি। নাইজেরিয়ার সময় মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটেছে। নাইজেরিয়ার উত্তর পূর্বে লেক চাঁদ অঞ্চলের কুকাওয়া এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে।
কুকাওয়া বরাবরই জঙ্গি হামলার শিকার। এর আগেও বোকো হারাম এবং ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স একাধিক বার এই অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে। সব চেয়ে বড় হামলা চালানো হয়েছিল ২০১৮ সালে। কার্যত গোটা এলাকা খালি করে দিয়েছিল জঙ্গিরা। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় শিবিরে গিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায় দুই বছর সে ভাবে কাটানোর পরে এ বছরই ফের নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছিলেন সাধারণ মানুষ। সরকার গোটা এলাকায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। এলাকায় তৈরি হয়েছে একাধিক নিরাপত্তা চৌকি।
ধর্ম, বর্ণ, স্বাধীনতা নানা নামে উগ্রবাদ ছড়ায় বিশ্বে৷ বিভিন্ন মতাদর্শের উপর ভর করে গড়ে ওঠে জঙ্গি সংগঠন কিংবা সশস্ত্র বাহিনীও, যা অনেক সময় রূপ নেয় সন্ত্রাসে৷
ছবি: Reutersএকসময় পোশাকি নাম ছিল ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দি লিভ্যান্ট’৷ সংক্ষেপে আইএসআইএল কিংবা আইএসআইএস৷ তবে বেশি পরিচিত আইএস বা দায়েশ নামে৷ বিশ্বজুড়ে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে ২০১৪ সালে তারা আত্মপ্রকাশ করে৷ ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বের ৮৫টি দেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা জঙ্গি গোষ্ঠীটিতে যোগ দেয়৷ সিরিয়া, ইরাকের একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছিল তারা৷ তবে সম্প্রতি শেষ ঘাঁটিটিও হারিয়েছে আইএস৷
ছবি: Reutersজর্ডান-প্যালেস্টেনিয়ান মুসলিম ধর্মীয় গুরু আব্দুল্লাহ আজম৷ একটি জিহাদি জার্নালে আফগানিস্তানে লড়াইয়ের জন্য মুজাহিদিন বা বিদেশি যোদ্ধাদের বাহিনী গড়ার ধারণা দেন তিনি৷ ১৯৮৯ সালে মারা গেলেও তাঁর মতবাদই বৈশ্বিক জিহাদি ধারণার জন্ম দেয়৷ যার উপর ভিত্তি করে ১৯৮৮ সালে আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠা করেন ওসামা বিন লাদেন৷ আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহারের পরে আল-কায়দার শাখা ছড়িয়ে পড়ে অনেক মুসলিম দেশে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ausafবিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামেও আল-কায়দার জিহাদি মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে জঙ্গি সংগঠন গড়ে ওঠে৷ তারই একটি আল শাবাব৷ সোমালিয়ায় শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৬ সালে গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ দেশটিতে বহু বিদেশি নাগরিক হত্যার জন্য দায়ী তারা৷ আফ্রিকার এমন আরেকটি জঙ্গি গোষ্ঠী নাইজেরিয়ার বোকো হারাম৷ ২০১৪ সালে ৩০০ স্কুল ছাত্রী অপহরণের ঘটনায় গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসে৷
ছবি: Reuters/J. Penneyবর্ণবাদী মতবাদের উপর ভিত্তি করে বিশ্বে যুগে যুগে নানা গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে৷ বিংশ শতকে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ বা সাদাদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে অ্যামেরিকায় গড়ে ওঠে ‘কু ক্লুক্স ক্ল্যান’ নামের কট্টর বর্ণবাদী গোষ্ঠী৷ বর্ণবাদের উপর ভর করে ইউরোপে উত্থান হয় ফ্যাসিবাদের৷
ছবি: picture alliance / ZUMAPRESS.comসাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে পশ্চিমা দুনিয়ায় উগ্র ডানপন্থার প্রকটতা বাড়ছে৷ অ্যামেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত এই মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে৷ ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের প্রতি এর অনুসারীরা রক্ষণশীল৷ সবশেষ নিউজিল্যান্ডে হামলা করে ৫০ জনকে হত্যায় অভিযুক্তও তেমনই একজন৷
ছবি: Reuters/M. Mitchellসমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কিংবা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয় বিশ্বের অনেক উগ্র বামপন্থি সংগঠন৷ রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে, সরকারি কর্মকর্তা, সম্পদশালী মানুষদের তারা শত্রু বিবেচনা করে৷ ফিলিপিন্সের কমিউনিস্ট পার্টি নিও পিপলস আর্মি বা ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তারই উদাহরণ - যাদেরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করে আসছে দেশগুলোর সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Quraishiইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে ফিলিস্তিনিরা৷ এজন্য সশস্ত্র যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে হামাস, প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট, প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ৷ উগ্রতার কারণে এই দলগুলোকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এমন স্বাধিনতাকামী সংগঠন আছে আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, পাকিস্তান ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে৷
ছবি: picture-alliance প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নাইজেরিয়ার সময় মঙ্গলবার বিকেল চারটে নাগাদ ২২টি পিকআপ ট্রাকে করে এলাকায় ঢোকে জঙ্গিরা। নিরাপত্তাবাহিনীকে লক্ষ্য করে এলোপাথারি গুলি ছুড়তে থাকে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকালয়ে ঢুকে পড়ে তারা। লুঠ করা হয় ঘর বাড়ি সম্পত্তি। মারধর করা হয় স্থানীয় মানুষকে। তারপর একশরও বেশি মানুষকে বন্দি করে চলে যায় তারা।
বোকো হারামের মতোই ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স একটি উগ্র জঙ্গি সংগঠন। ইসলামের শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। গত দশ বছরে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তারা নাশকতামূলক কাজ করেছে। কয়েক হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। লেক চাঁদ অঞ্চলে তাদের ক্ষমতা গত কয়েক বছরে অনেকটাই বেড়েছে।
জাতি সংঘের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক কোটি মানুষ গৃহহীনঅবস্থায় আছেন এই অঞ্চলে। বেঁচে থাকার জন্য সব রকম সাহায্য তাঁদের দেওয়া প্রয়োজন। বস্তুত, গৃহহীন এই মানুষদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে নাইজেরিয়ার সরকার। অনেককেই আশ্রয় শিবির থেকে গ্রামে ফেরার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলির বক্তব্য, গ্রামে ফিরে যাওয়া এখনও নিরাপদ নয়। গ্রামে ফিরলে কী হতে পারে, মঙ্গলবারের ঘটনাই তার প্রমাণ।
এসজি/জিএইচ (রয়টার্স, ডিপিএ)