দু'বছরেরও বেশি আগে উত্তর নাইজেরিয়ার চিবক থেকে ২৭০ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করেছিল বোকো হারাম৷ অবশেষে দু'জন ফিরে এসেছে৷ এটা নিশ্চয়ই আন্দের৷ তবে টোমাস ম্যোশ মনে করেন, এর মধ্যে শঙ্কার ইঙ্গিতও আছে অনেক৷
বিজ্ঞাপন
নাইজেরিয়া, তথা সারা বিশ্বের মানুষ দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে যে দিনটির অপেক্ষায় ছিল অবশেষে সেই দিনটি এলো৷ অবশেষে ২০১৪ সালের এপ্রিলে অপহৃত হওয়া স্কুলছাত্রীদের দু'জন ফিরে এসেছে৷ মেয়ে দু'টির পরিবারের জন্য এটি খুবই আনন্দের, কেননা, এর মাধ্যমে তাঁদের এতদিনের অপেক্ষা এবং প্রার্থনা সার্থক হয়েছে৷
অপহৃত মেয়দের পরিবারকে যাঁরা এতদিন সমর্থন জুগিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে ‘ব্রিং ব্যাক আওয়ার গার্লস' গ্রুপও মেয়ে দু'টি ফিরে আসায় খুশি হতে পারে, কারণ, এতগুলো দিন ধরে কেউ যাতে অপহৃত মেয়েদের ভুলে না যায়, সেই লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করেছে৷ প্রথম মেয়েটির ফিরে আসার ছবি বড় একটা আশাও জাগিয়েছে, কারণ,সে জানিয়েছে, তার অন্য জিম্মি সঙ্গীদের অধিকাংশই এখনো জীবিত৷
কিন্তু উত্তর নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি গত দু'বছর ধরে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল সেটাকে সমর্থনই করছে৷ জঙ্গল থেকে মেয়েটি বেরিয়ে এসেছে কোলে একটি শিশু নিয়ে৷ একটি পুরুষ মানুষও এসেছে, যাকে আবার মেয়েটি নিজের স্বামী হিসেবেই পরিচয় করিয়েছে৷ সেনাবাহিনীর সন্দেহ, লোকটি বোকো হারাম জঙ্গি৷
অপহরণ কাণ্ডের পর থেকেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করে আসছেন, মেয়েগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা হয় জোর করে বিয়ে করবে, নয়ত নাইজেরিয়ার ভেতরেই কোথাও বিক্রি করে দেবে৷ তথাকথিত জঙ্গি সংগঠনটির নেতা আবু বকর শেকাউকেও এক ভিডিও বার্তায় এমন কথা বলতে শোনা গেছে, পালিয়ে আসা মেয়েরাও আগে একই কথা বলেছে৷
তাই আশা আর আনন্দ জাগানো এই সময়েও বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে৷ স্থানীয় তদারকি সংস্থা এবং সেনাবাহিনী তো মেয়ে দু'টিকে উদ্ধারের ঘটনাকে নিজেদের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে৷ সাম্বিসা বনের কাছে একজন পুরুষ, একজন নারী এবং এক শিশুকে উদ্ধারের কৃতিত্বও দাবি করছে তারা৷
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, লোকটি ওই মেয়ে আর শিশুটিকে নিয়ে বোকো হারামের আস্তানা থেকে না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচতে বেরিয়ে এসেছে৷ তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, বোকো হারামের কাছে এখনো দু'শরও বেশি স্কুলছাত্রী এখনো জিম্মি আছে৷
তবে প্রশ্ন হলো, বোকো হারাম যেখানেএতজন অপহৃতকে আটকে রাখতে পারছে, সেখানে এতদিন পর হঠাৎ একজন কেমন করে বেরিয়ে এলো? কয়েকজন বিশ্লেষক এবং সেনাবাহিনী মনে করে, মেয়েরা কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল আর সে কারণে তাঁদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়৷ আমরা কি এই ব্যখ্যাকেই ঠিক ধরে নেবো?
তথাকথিত জঙ্গি সংগঠনটির কাছে কি চিবকের মেয়েগুলো সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেনদরবারের শেষ টোপ? কারণ তারা তো জানে, মেয়েগুলোও মারা যেতে পারে এই আশঙ্কা মেনে নিয়ে সেনাবাহিনী কখনো আক্রমণ করবে না৷ মেয়েগুলোকে মুক্ত করতে সরকার বোকো হারামের সঙ্গে আলোচনা করছে – এমন একটি কথা তো প্রায়ই শোনা যাচ্ছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে জিম্মি মেয়েদের নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়া হয়ত তারই আলামত৷ অনেকেই বলছেন, মেয়েরা যে জীবিত আছে এটা জানানোর জন্য সরকার পক্ষের মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ভিডিওটি পাঠানো হয়৷
সেনাবাহিনী এবং রাজনীতিবিদরা যেভাবে মেয়ে দু'টির ফিরে আসাকে নিজেদের জয় হিসেবে উদযাপন করছে এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত৷ সরকারের দেয়া তথ্যেও তো এটা পরিষ্কার যে, এটা যতটা না সামরিক বা রাজনৈতিক সাফল্য, তার চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যপ্রসূত৷ সুতরাং বাকি ২১৭ জন চিবক কন্যা এবং আরো শহস্র অজ্ঞাতনামা নারীর অজানা নিয়তির কথা মনে রেখে আনন্দ উদযাপন একটু সংযতভাবেই করা উচিত৷ মনে রাখতে হবে, বোকো হারাম হয়ত কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তবে এখনো কিন্তু প্রতিদনই তারা মানুষ হত্যা করছে৷
যে লড়াই আজও চলছে...
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান সংঘাত নিয়ে গবেষণা করছে হাইডেলবার্গ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রিসার্চ (এইচআইআইকে)৷ তাদের হিসেবে, গত বছর গোটা বিশ্বে চারশোর মতো সংঘাত ঘটেছে, যার বিশটি সরাসরি যুদ্ধ৷ এই নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
শান্তির কোনো লক্ষণ নেই
ধর্মান্ধতা, দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থের লোভ কিংবা ক্ষমতা দখলের বাসনা – হাজার হাজার বছর ধরে যুদ্ধ, সংঘাতের কারণ ঘুরে ফিরে এগুলোই৷ ২০১৩ সালেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ হাইডেলবার্গ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রিসার্চ (এইচআইআইকে) গত বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু সংঘাত, যুদ্ধের কথা প্রকাশ করেছে ‘কনফ্লিক্ট ব্যারোমিটার ২০১৩’ শিরোনামে৷
ছবি: Reuters
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো
গত বছর কিভু-তে সেনাবাহিনী নিয়মিত এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে৷ ২০১৩ সালের শেষের দিকে অবশ্য সরকার ঘোষণা দেয়, বিদ্রোহীদের দমনে সক্ষম হয়েছে তারা৷ অন্যদিকে এম২৩ গোষ্ঠীর ঘোষণা, এখন থেকে রাজনৈতিক পথে দাবি আদায়ের চেষ্টা করবে তারা৷
ছবি: Melanie Gouby/AFP/GettyImages
মালি
মালিতে উগ্র ইসলামপন্থিরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে৷ ২০১২ সালে সে দেশের উত্তরাঞ্চলের একটা বড় অংশ তাদের দখলে চলে যায়৷ ফলশ্রুতিতে মালি সরকারকে যুদ্ধে সহায়তায় এগিয়ে আসে ফ্রান্স৷ এরপর পিছু হটতে বাধ্য হয় উগ্র ইসলামপন্থিরা৷ বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মালিতে শান্তি রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে৷ তবে সে দেশে বিভিন্ন জঙ্গি এবং আত্মঘাতী হামলার খবর মাঝে মাঝেই শোনা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাইজেরিয়া
উগ্র ইসলামপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়৷ এই লক্ষ্য পূরণে সে দেশের খ্রিষ্টান এবং মধ্যপন্থি মুসলমানদের উপর হামলা অব্যাহত রেখেছে গোষ্ঠীটি৷ ছবিতে একটি হামলায় নিহতদের জন্য সমাধি খুঁড়ছেন তাদের খ্রিষ্টান আত্মীয়রা৷ নাইজেরিয়ায় আরো একটি সংঘাত চলছে৷ তৃণভূমি ইস্যুতে খ্রিষ্টান কৃষকরা লড়াই করছেন গবাদি পশু পালক মুসলমানদের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুদান
গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে দারফুর অঞ্চলে বসবাসকারী আফ্রিকার বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারি বাহিনী এবং তাদের অনুসারীদের সঙ্গে লড়াই করছে৷ যুদ্ধের কারণে কয়েক লাখ মানুষ ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে এবং অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটো বাহিনী স্থানীয় বাহিনীর হাতে সে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও সংঘাত অব্যাহত রয়েছে৷ তালেবান এবং অন্যান্য চরমপন্থি গোষ্ঠী সে দেশের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা এবং ‘বুবি-ট্র্যাপ’-এর মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে সংঘাত থামার কোন লক্ষণ নেই৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ২০১৩ সালে আড়াই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেক্সিকো
মাদক, মানবপাচার, ব্ল্যাকমেল এবং চোরাচালানের মতো কর্মকাণ্ড মেক্সিকোর মাফিয়াদের অর্থ উপার্জনের উৎস৷ আয়ের এসব উৎস নিরাপদ রাখতে মাফিয়ারা একে অপরের সঙ্গে এবং প্রয়োজনে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷ সে দেশে প্রতি সপ্তাহেই দাঙ্গার ঘটনা ঘটে৷ মেক্সিকো সরকারের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর সে দেশে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিরিয়া
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে৷ সেদেশ কার্যত বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে গেছে৷ কিছু অংশের দখল রয়েছে সে দেশের প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছে, বাকি বিভিন্ন অঞ্চল মধ্যপন্থি বিরোধী দল, উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং নব্বই লাখের মতো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: Mohmmed Al Khatieb/AFP/Getty Images
ফিলিপাইন্স
চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিপাইন্সে মোরো সম্প্রদায় স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে৷ মাঝে কিছুদিন অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকার পর ২০১৩ সালে আবারো তারা শুরু হয়েছে সহিংস সংগ্রাম৷ বিদ্রোহী গোষ্ঠী এমএনএলএফ সে দেশের দক্ষিণের দ্বীপগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে৷ যুদ্ধের কারণে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: Reuters
সোমালিয়া
সোমালিয়ায় আল-শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ চলছে গত আট বছর ধরে৷ জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের সেনাদের সহায়তায় সোমালিয়া সরকার আল-শাবাবকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে৷ তবে এখনো সে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় অংশ জঙ্গি গোষ্ঠীর দখলে রয়েছে৷
ছবি: Mohamed Abdiwahab/AFP/Getty Images
দক্ষিণ সুদান
তিন বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করা দক্ষিণ সুদানে এখনো সংঘাত অব্যাহত রয়েছে৷ সে দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্টের পক্ষের সেনারা প্রেসিডেন্সিয়াল ফোর্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া প্রতিবেশী দেশ সুদানের দুটি রাজ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছে দক্ষিণ সুদানের সেনারা৷
ছবি: Reuters
11 ছবি1 | 11
ভুলে গেলে চলবে না যে, বোকো হারামের কবল থেকে মুক্ত করে আনা অনেক নারী, পুরুষ, শিশু এখন সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছে৷ গত সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে, মাইদুগুরির কাছের একটি ডিটেনশন সেন্টারেই আটক রয়েছে ১,২০০ জন৷ তাদের মধ্যে অনেকে মারাও যাচ্ছে৷ শুধু এ বছরেই মারা গেছে ১২০ জন৷ চিবকের মেয়েদের প্রত্যাবর্তনের আনন্দ যেন ভুলিয়ে না দেয় যে, বোকো হারাম অধ্যায় শেষ হওয়ার আগে নাইজেরিয়ার সরকার এবং সেনাবাহিনীকে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে৷