চলতি পথে মাঝে মাঝে কিছু মানুষ দেখে মুগ্ধ হই৷ ব্যক্তিস্বার্থকে পাশে রেখে মানবসেবায় নিয়োজিত হয়েছেন তারা৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলেতে আসার পথে মাঝেমাঝেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়৷ জাতিসংঘের কার্যালয়ের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন পরিবেশ রক্ষার দাবি সম্বলিত প্লাকার্ড নিয়ে৷ শেষবার তাঁকে দেখেছিলাম গাড়ির চাকার টায়ার থেকে সৃষ্টি হওয়া পার্টিকেল নিয়ে কথা বলতে৷ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই পার্টিকেলের বিষয়ে নাকি কেউই তেমন একটা সচেতন নন৷
অন্যরকম বাংলাদেশের গল্প!
কে বলে মানুষ শুধু নিজের কথাই ভাবে! বাংলাদেশে এখনও এমন অনেকেই আছেন যারা তাদের জীবনের বড় সময়টাই কাটিয়ে দিচ্ছেন সমষ্টির জন্যে৷ এমনই কিছু উদ্যোগের গল্প থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Gram Pathagar Andolon
পক্ষাগাতগ্রস্থদের ভরসা
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে আসেন ব্রিটিশ সাইকোথেরাপিস্ট ভ্যালেরি টেইলর৷ ১৯৭৯ সালে স্থানীয় একটি দল নিয়ে গড়ে তোলেন সেন্টার ফর দ্য রিহেবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড৷ পক্ষাগাতগ্রস্তদের চিকিৎসায় সিআরপি এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে আস্থার নাম৷ যার পরিচিতি ছাড়িয়ে গেছে দেশের গণ্ডি৷ চিকিৎসা, থেরাপি, পুনর্বাসন, পক্ষাগাতগ্রস্থদের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি ছাড়াও সিআরপির রয়েছে ইনস্টিটিউট, নার্সিং কলেজ, স্কুল৷
ছবি: Centre for the Rehabilitation of the Paralysed
এক টাকায় আহার
সবার জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০১৩ সালে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর কুমার দাশ৷ ২০১৬ সালে তারা চালু করে এক টাকার আহার৷ প্রকল্পটির আওতায় দরিদ্র শিশু ও বৃদ্ধরা এক টাকায় পেট ভরে খেতে পান৷ প্রায় দুই হাজার পথশিশুকে তারা প্রতিদিন খাবার দেন৷ এই খাবারের খরচ দিতে পারেন যে কেউ৷ এজন্য যেতে হবে তাদের ওয়েবসাইটে৷
ছবি: bdnews24.com/A.M. Ove
পোস্টার থেকে স্কুলব্যাগ
১৩টি শাখায় দুই হাজার পথশিশুকে পড়াশোনার সুযোগও করে দিয়েছে বিদ্যানন্দ৷ আছে নারীদের জন্য বাসন্তি প্রকল্প৷ ৪০ একর জায়গার উপরে তাদের আছে ছয়টি এতিমখানা৷ সেখানে ৪০০ শিশু থাকছে৷ সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পোস্টার দিয়ে শিশুদের জন্য তারা ব্যাগ তৈরি করেছে৷ এসব উদ্যোগের পাশাপাশি এবারের বইমেলায় তারা আলোচনায় এসেছে পুরনো মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও ওষুধের বিনিময়ে নতুন বই দিয়ে।
ছবি: Abdul Gani
প্রবীণদের আশ্রয়
শেষ বয়সে এসে অনেক প্রবীণই হয়ে যান একা৷ অনেকের দায়িত্ব নিতে চান না সন্তানেরা৷ তাদের জন্য ভরসা চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার৷ ২০১৫ সালে যা গড়ে তোলেন মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী মিঠু হালদার৷ মিরপুরে নিজের ভাড়া করা দুটি বাড়িতে এখন পর্যন্ত ৭৫ জন বৃদ্ধকে সেবা দিয়েছেন তারা৷ ৭৫ জনের মধ্যে ১১ জন মারা গেছেন৷
ছবি: Child & Old Age Care
ইশকুল যখন মজার
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করে মজার ইশকুল৷ ২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগে ১৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়৷ পরে তাদের স্কুল কার্যক্রম শুরু হয় ঢাকার বিভিন্ন জায়গায়৷ ২০১৮ সালে শিশুদের পড়ানোর পাশাপাশি খাবার কর্মসূচীও চালু করে তারা৷ বর্তমানে তাদের চারটি খোলা আকাশের নীচে, চারটি স্থায়ীসহ মোট আটটি স্কুল রয়েছে৷ আছে ১৫০০-র বেশি শিক্ষার্থী৷
ছবি: Mojar Ishkul
প্রতি গ্রামে পাঠাগার
‘প্রতি গ্রামে হোক একটি পাঠাগার,’ এমন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন৷ ২০০৬ সালে সাত তরুণ শুরু করেন এই উদ্যোগ৷ টাঙ্গাইলে ভূঞাপুরে তারা গড়ে তোলেন অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার৷ এরপর একে একে ৫৮টি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে৷ এখানেই শেষ নয়৷ পাঠাগারের উদ্যোক্তা আর সদস্যদের নিয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক বিভিন্ন কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা৷
ছবি: Gram Pathagar Andolon
পাঠাগার থেকে বিদ্যালয়
পাঠাগারের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য স্কুল কলেজ গড়ে তুলছেন গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের কর্মীরা৷ সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে ভূঞাপুর যমুনার কোল ঘেঁষা একটি গ্রামে গড়ে তুলেছেন হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজ ও বঙ্গবন্ধু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ রংপুরের গোবিন্দগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেছেন শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ স্মৃতি বিদ্যা নিকেতন৷
ছবি: Gram Pathagar Andolon
অসহায়দের বন্ধু শওকত
যেসব মানুষের ধারে-কাছে কেউ ঘেঁষেন না, যারা ক্ষত হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে রাস্তায় ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুণেন, তাদের ত্রানকর্তা পুলিশ কনস্টেবল মুহাম্মদ শওকত হোসেন৷ বছরের পর বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন৷ পরম আদরে মানুষগুলোকে তিনি রাস্তা থেকে তুলে আনেন৷ তাদের সেবা-যত্ন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন৷ প্রতি মাসের বেতন, কিংবা উৎসব ভাতা নিজের জন্য নয়, খরচ করেন তিনি এই মানুষদের পেছনেই৷
ছবি: Privat
মানুষ প্রাণীদের জন্যেও
আহত প্রাণীদের সহায়তা, প্রাণী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বা ‘প’ ফাউন্ডেশন৷ সংগঠনটির ফেসবুকে পেইজে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের যাত্রা শুরু হয়৷ পরবর্তীতে তারা প্রাণীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলে৷ অসুস্থ প্রাণীদের চিকিৎসাসহ মানুষের মধ্যে পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসার উদ্রেক ঘটাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন তাদের কার্যক্রম রয়েছে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Reuters/A. Song
9 ছবি1 | 9
অ্যালেন মিটশাম শুধু জাতিসংঘের সামনেই নয়, আরো কয়েক জায়গায় প্রতিবাদ করতে যান৷ তার বাহন একটি সাইকেল৷ কখনো কখনো নানা ফেস্টুনে ঢাকা সেই সাইকেলটা দেখি ট্রেন স্টেশনের পাশে পার্ক করে রাখা হয়েছে৷ তাঁর এই কর্মকাণ্ড দেখতে ভালোই লাগে৷ মনে আশা জাগে এই ভেবে যে, সবকিছু ফেলে শুধু প্রতিবাদ করে যাওয়া মানুষ এখনো আছে৷ আর তারা সেসব করেন কোনোরকম প্রচারের আশা ছাড়াই৷
২০১৭ সালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে দেখা হয়েছিল এক ইউরোপীয়র সঙ্গে৷ ইউরোপের লোভনীয় চাকরি ফেলে তিনি কয়েক মাসের জন্য সেখানে চলে গেছেন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের সহায়তা করতে৷ ব্যক্তি উদ্যোগে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তিনি নিজের সাধ্যমতো সহায়তা করছিলেন তাদের৷
সেই ব্যক্তি বাংলাদেশে যেতেন পর্যটক ভিসায়৷ কয়েক সপ্তাহ পর পর তাঁর নতুন করে ভিসা নিতে হতো৷ ভিসা নেয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল ছিল৷ বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে পাশের কোনো দেশে কয়েকদিন কাটিয়ে তারপর আবার বাংলাদেশে আসতেন তিনি৷ বিমানবন্দর থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য পেতেন ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা'৷
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রোহিঙ্গাদের তো অনেক দেশি-বিদেশি সংগঠন সহায়তা করছে, আপনি তারপরও এভাবে ঝুঁকি নিয়ে একা একা তাদের সহায়তা করছেন কেন? তিনি জানিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত তাগাদা থেকেই কাজটা করেন তিনি৷ নিজের সন্তান নেই, রোহিঙ্গা শিশুদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে সন্তান লালনপালনের আনন্দটা উপভোগ করেন তিনি৷
সেই ইউরোপীয়কে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তিনি এতটাই প্রচারবিমুখ যে, তাঁর নামটা ব্যবহারেরও অনুমতি দেননি৷
গতবছর যখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাই, তখন পরিচয় হয় সোফিয়া ডিনেয়েলসনের সঙ্গে৷ তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা শরণার্থীদের হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বেড়ান৷ তাদের কেউ হয়ত বাংলাদেশে, কেউ মালয়েশিয়ায়, কেউবা সৌদি আরবে আছেন৷ গত পাঁচ বছর ধরে এই কাজটা করে যাচ্ছেন সেই মার্কিনী৷
উপরের যে তিনটি ঘটনার কথা বললাম, সেগুলোর কোনোটিই গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি৷ গ্রেটা টুনব্যার্গের জনপ্রিয়তার কাছেপিঠেও নেই অ্যালেন মিটশাম৷ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা এই ইউরোপীয়র কথা জানে আমার মতো অল্প কিছু মানুষ৷ আর সোফিয়া ইন্সটাগ্রামে কিছুটা পরিচিত৷ তাদের মতো প্রচারের বাইরে থাকা জনদরদীদের প্রতি শ্রদ্ধা৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷