নাগর্নো-কারাবাখে দুই হাজার সেনা, ৯০টি ট্যাঙ্ক এবং ৩৮০টি গাড়ি পাঠালো রাশিয়া। বুধবার থেকে গোটা এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী শক্তি হিসেবে সেখানে অবস্থান করবে রাশিয়ার সেনা। সোমবারই আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং রাশিয়ার মধ্যে নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল। সেই চুক্তিতেই বলা হয়েছিল, আপাতত গোটা এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেবে রাশিয়ার সেনা বাহিনী।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টএর্দোয়ান মঙ্গলবার জানিয়েছেন, রাশিয়ার পাশাপাশি তুরস্কও নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেবে। বস্তুত, সোমবারের চুক্তির পর আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান কোনো পক্ষই আর যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। আজারবাইজান সোমবারের চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিষয়টিকে তাদের জয় হিসেবেই দেখছে। মঙ্গলবার আজারি প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ জানিয়েছেন, বহু দিন ধরেই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন আজারবাইজানের মানুষ। অন্য দিকে আর্মেনিয়ায় মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে বিক্ষোভ। কেন সরকার এই চুক্তি মেনে নিল, তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনয়ান মঙ্গলবারও বলেছেন, মন ভার করেই তাঁকে এই চুক্তি মেনে নিতে হয়েছে।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
নব্বইয়ের দশক থেকে নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার সংঘর্ষ। সে সময় দুই পক্ষের যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যুদ্ধ থামলেও বিতর্ক থামেনি। আন্তর্জাতিক ভাবে নাগর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের এলাকা হলেও সেখানে বসবাস করেন আর্মেনিয়ার জনগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কার্যত স্বাধীন সরকার পরিচালনা করেছে। আর্মেনিয়া তাদের মদত দিয়েছে। এরই বিরুদ্ধে এ বার ফের যুদ্ধ শুরু করে আজারবাইজান। গত প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দুই পক্ষেরই।
রাশিয়া এবং অ্যামেরিকা এর আগে তিনবার যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেছে। দুই দেশকে বৈঠকেবসিয়েছে। চুক্তিও হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। সোমবারের চুক্তি নিয়েও অনেকের ধারণা ছিল, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থামবে না। কিন্তু মঙ্গলবার এবং বুধবার সকালে কোনো পক্ষই সংঘর্ষে নামেনি। তারই মধ্যে এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে রাশিয়ার সেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তিতে আসলে লাভ হয়েছে আজারবাইজানের। ঠিক হয়েছে, সাম্প্রতিক যুদ্ধে যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সে সেখানেই থাকবে। আজারবাইজান শেষ কিছু দিনে নাগর্নো-কারাবাখের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি দখল করে ফেলেছে। রাজধানী লাগোয়া শুশা এখন তাদের দখলে। ফলে চুক্তিতে তাদেরই লাভ হয়েছে বেশি। এ ছাড়াও চুক্তিতে বলা হয়েছে, ধীরে ধীরে আর্মেনিয়া নাগর্নো-কারাবাখের জমি ছেড়ে দেবে।
মঙ্গলবার থেকেই আর্মেনিয়ায় এই চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সরকারি অফিসের সামনে জনগণ লাগাতার আন্দোলন করছে। চুক্তি ভেঙে ফের আক্রমণের কথাও বলছেন অনেকে। যদিও রাশিয়া এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করে দেওয়ার পর তা আর সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।