যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান৷ বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা৷ হামলা নিয়ে দুই পক্ষের পালটা দাবিতে সংকট আরো বাড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
সপ্তাহ পেরুতে চললেও বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে লড়াই অব্যাহত রয়েছে৷ এরিমধ্যে ২৩০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন৷
রোববার আজারবাইজান তাদের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর গ্যাঞ্জেতে আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনী হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে৷ পাশপাশি নাগর্নো-কারাবাখ এর সীমান্তবর্তী তাদের আরো দুটি শহরে গোলা বর্ষণের অভিযোগ করেছেন আজেরি প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷ এতে দুই দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো খারাপ দিকে মোড় নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
আজারবাইজানের এই দাবি অস্বীকার করেছে আর্মেনিয়া৷ তবে নাগর্নো-কারাবাখে তাদের সমর্থিত আর্মেনিয়ানদের প্রধান আরাইক হারুতিউনইয়ান গ্যাঞ্জেতে একটি বিমান ঘাঁটিতে হামলার কথা স্বীকার করেছেন৷ আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী নাগর্নো-কারাবাখ এর প্রধান শহর স্টেপানকিয়ার্টে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালিয়েছে বলে পালটা অভিযোগ করেন তিনি৷
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের ছবি
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে চলছে যুদ্ধ৷ মৃত্যু হয়েছে কয়েকশ মানুষের৷ অন্য কোন দেশ কারো পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিলেও, এই যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ আর্মেনিয়ার।
ছবি: Vahram BaghdasaryanReuters
সংঘাতের কারণ
দুই দেশের সীমান্তে ককেশাস পর্বতে বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের দখল নিয়ে সংঘাত শুরু হয়েছে। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুইটি দেশই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সোভিয়েতের পতনের পর দু'টি দেশ আলাদা হয়ে যায়। তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক।
ছবি: Defence Ministry of Armenia/Reuters
কারাবাখের অবস্থান
দুই দেশের সীমান্তে নাগর্নো-কারাবাখে আর্মেনিয়ার মানুষ থাকেন। তবে এলাকাটি স্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। তাদের নিজস্ব প্রশাসনও আছে। আর্মেনিয়ার যথেষ্ট প্রভাব আছে ওই অঞ্চলে। আজারবাইজানের দাবি, এলাকাটি তাদের ভূখণ্ডের অংশ।
আর্মেনিয়ার বক্তব্য আজারবাইজান জোর করে নাগর্নো-কারবাখের দখল নিতে চাইছে। ওই অঞ্চলে আর্মেনীয় মানুষ বাস করেন। ফলে কোনোভাবেই তা আজারবাইজানের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তারাও যুদ্ধ থামাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture-alliance
তুরস্কের অবস্থান
আর্মেনিয়ার বক্তব্য, তুরস্ক যুদ্ধে আজারবাইজানকে সাহায্য করছে। তুরস্কের যুদ্ধবিমান আর্মেনিয়ার যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করেছে বলেও অভিযোগ। তুরস্ক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা যে আজারবাইজানের পক্ষে, তুরস্ক সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।
ছবি: Armenian Defense Ministry
মৃত্যু হচ্ছে কাদের
দুই দেশের এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করছেন সামরিক-বেসামরিক নাগরিক। শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি৷ এর মধ্যে ৩০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক৷ অন্যদিকে কারাবাখের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার’ তাদের ৫৪ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে শুক্রবার দাবি করেছে৷
ছবি: Celestino Arce Lavin/Zuma/picture-alliance
বিশ্বের অবস্থান
যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানিয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া, অ্যামেরিকা, ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি পেশ করেছে।
ছবি: Vahram BaghdasaryanReuters
7 ছবি1 | 7
এর আগে বিতর্কিত অঞ্চলটির একটি শহর ও সাতটি গ্রাম দখলে নেয়ার দাবি করে আজারবাইজন৷ অন্যদিকে নাগর্নো-কারাবাখে বসবাসরত আর্মেনিয়দের সুরক্ষায় সব ধরনের উপায় ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে আর্মেনিয়া৷ আজারবাইজানের তিনটি বিমান ভূপাতিত করার দাবিও করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সুশান স্টেপানিয়ান, যদিও এই তথ্য অস্বীকার করেছে বাকু৷
বিতর্কিত অঞ্চল নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে গত রোববার দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকেই এই অঞ্চলে দুই দেশের বিরোধ চলছে৷ ১৯৯০ এর দশকে আর্মেনিয়ান নৃগোষ্ঠী আজারবাইজানের কাছ থেকে কারাবাখ দখল করে৷ এ নিয়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সেসময়ই৷ শুরু হয় যুদ্ধ, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ৷
১৯৯৪ সালে দুই পক্ষের মধ্য যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সরাসরি সংঘাতের ইতি ঘটলেও এ নিয়ে দুইদেশের বিবাদ অব্যাহত ছিল৷ নিজেদের অঞ্চল পুনরায় দখলে বেশ কয়েকবারই হুমকি দিয়েছে আজারবাইজান৷
গত রোববার নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতে তুরস্ক ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক শক্তি জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ এরিমধ্যে তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে৷
এফএস/জেডএ (এএফপি, ডিপিএ, রয়টার্স)
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷