চুক্তি মেনে নাগর্নো-কারাবাখের শেষ প্রদেশে পৌঁছে গেল আজারি সেনা। টাঙিয়ে দেওয়া হলো দেশের জাতীয় পতাকা।
বিজ্ঞাপন
নাগর্নো-কারাবাখের সর্বশেষ অঞ্চলে আজারি পতাকা টাঙালো আজারবাইজানের ফৌজ। মঙ্গলবার দেশের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানালেন, 'নতুন বাস্তবতা'র সূচনা হলো। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এটা উদযাপনের সময়। বহু দিন ধরে প্রতীক্ষার পর সাফল্য অর্জন করেছে আজারবাইজান।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে শান্তিচুক্তি সই হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, নাগর্নো-কারাবাখের মূল তিনটি প্রদেশ বা অঞ্চল আগদাম, লাচিন এবং কালবাজার আজারবাইজানের হাতে সমর্পন করতে হবে আর্মেনিয়াকে। আর্মেনিয়ার জনতা এই চুক্তিকে মেনে নিতে রাজি হননি। তাঁদের বক্তব্য, এর ফলে সমস্ত লাভই আজারবাইজানের হলো। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীও সে কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু চুক্তি বদলের আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এর পর থেকে আর্মেনিয়াতে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। তারই মধ্যে আর্মেনিয়ার এবং নাগর্নো-কারাবাখের যোদ্ধারা এলাকা ছাড়তে শুরু করেন। নাগর্নো-কারাবাখের ওই তিনটি অঞ্চল ফাঁকা করে দেওয়ার জন্য আর্মেনিয়াকে সময় বেঁধে দেয় আজারবাইজান।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
আগদাম এবং কালবাজারে আগেই ঢুকে পড়েছিল আজারবাইজানের সেনা। মঙ্গলবার তারা পৌঁছে যায় লাচিনে। সেখানে আজারবাইজানের পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। আজারবাইজানের সেনার সঙ্গে লাচিনে পৌঁছেছিল রাশিয়ার সেনাও। কোনো গণ্ডগোল যাতে না হয়, তার জন্য এই মুহূর্তে নাগর্নো-কারাবাখে প্রায় দুই হাজার রাশিয়ার সেনা রয়েছে।
লাচিন স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। লাচিনের রাস্তা নাগর্নো-কারাবাখের রাজধানীর সঙ্গে আর্মেনিয়ার যোগাযোগ স্থাপন করে। ফলে লাচিন আজারবাইজানের হাতে থাকার অর্থ, আর্মেনিয়ার সঙ্গে নাগর্নো-কারাবাখের সরাসরি যোগাযোগ পথের উপর একটি বড় বাধা।
আজারি সেনা এখনো পর্যন্ত নাগর্নো-কারাবাখের যে অঞ্চলেই ঢুকেছে সেখানেই দেখেছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে সেখানকার আর্মেনীয় জনজাতির মানুষ পালিয়ে গিয়েছেন। লাচিনেও সেই একই ছবি দেখা গিয়েছে। তবে সেখানে ৪৮ বছরের এক ব্যক্তি থেকে গিয়েছেন। স্থানীয় মুদিখানার দোকান চালান তিনি। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে মন চায়নি তাঁর। তাই থেকে গিয়েছেন। এতদিন ধরে তিলে তিলে তৈরি করেছেন দোকান, সংসার। যদি চলে যেতে হয়, তা হলে সব কিছু পুড়িয়ে দিয়ে যাবেন।