১০ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে। তারই মধ্যে এই প্রথম সমঝোতার কথা বললেন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের যুদ্ধ দশম দিনে পড়ল। এখনো পর্যন্ত যুদ্ধ থামার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। আর্মেনিয়ার দাবি, বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের রাজধানী কার্যত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে আজারবাইজানের সেনা। আজারবাইজানও আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছে। তবে এরই মধ্যে সামান্য আশার আলো দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, আজারবাইজান চাইলে নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতায় আসার কথা ভাবা যেতে পারে। অন্যদিকে ইরান ফের আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, যে ভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তাতে অচিরেই দুই দেশের লড়াই একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দুইটি দেশের সঙ্গেই ইরানের সীমান্ত রয়েছে। সোমবারের পরে মঙ্গলবার ফের নিজেদের সীমান্ত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইরান। ইরানের প্রেসিডেন্ট ফোনে কথা বলেছেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন দেশের নানা গোষ্ঠী এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ফলে যে কোনো সময় একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এবং তা ঘটলে গোটা অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবে। ফলে দ্রুত সমাধানের রাস্তা খুঁজে বার করা দরকার। বস্তুত, এই যুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ যে রয়েছে, তা প্রথম থেকেই বলছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সিরিয়ার সরকার স্বীকার করেছে, যুদ্ধে সিরিয়ার যোদ্ধারা অংশ নিয়েছে। আরও কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের কথাও শোনা যাচ্ছে। তুরস্কের সরাসরি যোগদান নিয়েও সরব হয়েছে আর্মেনিয়া।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
এ দিকে মঙ্গলবার আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের চুক্তি রয়েছে। যার ভিত্তিতে আর্মেনিয়ার প্রয়োজনে রাশিয়া তাদের সাহায্য করবে। তিনি জানিয়েছেন, আজারবাইজান যুদ্ধ চালিয়ে গেলে রাশিয়া আর্মেনিয়াকে সাহায্য করবে এবং তার ফলে দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, আজারবাইজান চাইলে পারস্পরিক সমঝোতার কথা ভাবা যেতে পারে। বস্তুত, এই প্রথম সমঝোতার কথা বলা হলো।
কোন পথে সমঝোতা?
নাগর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের অংশ। কিন্তু সেখানে বসবাস করেন আর্মেনীয় মানুষ। আজারবাইজানের কর্তৃত্ব তাঁরা মানেন না। ফলে সেখানে স্বাধীন সরকার গড়ে উঠেছে। যাদের পিছন থেকে সাহায্য করে আর্মেনিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই এই অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে নতুন করে সমঝোতা করতে হলে দুই দেশকে নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করতে হবে। নাগর্নো-কারাবাখের স্বাধীন সরকারের বক্তব্যও এ ক্ষেত্রে জরুরি। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যুদ্ধ থামাতে হলে সমঝোতার রাস্তায় যেতেই হবে দুইটি দেশকে। এবং যে ভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের উপর চাপ তৈরি করেছে, তাতে এ ছাড়া আপাতত তাদের আর কোনও উপায়ও নেই।