উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে অস্বস্তি আরো বাড়লো মোদী সরকারের। রোববার আপাত শান্ত অরুণাচলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। মৃত্যু হয়েছে এক সেনা জওয়ানের। সোমবার তার জের কাটতে না কাটতেই একটি চিঠি প্রকাশ করল নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দ্য ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড। যেখানে বলা হয়েছে, সাত মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে শান্তি আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দলটি। কিন্তু সরকারের তরফে এখনো পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি।
দীর্ঘদিন ধরে নাগাল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দ্য ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড। এক সময় অস্ত্র নিয়ে লড়াই করলেও দীর্ঘ দিন ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে তাদের। প্রায় দুই দশক ধরে নাগাল্যান্ড সহ উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে শান্তিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিযোগ, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কাশ্মীরের মতোই উত্তর-পূর্ব ভারতেও নতুন করে অশান্তি শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সেই ইঙ্গিত দিয়েই একটি চিঠি প্রকাশ করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি। তারা জানিয়েছে, সাত মাস আগে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অফিসে চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি এই সংগঠনটি। দেশের বাইরে কোনো জায়গায় বৈঠক হতে পারে।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী দফতর সেই চিঠির কোনও জবাব পর্যন্ত দেয়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির দাবি নাগাল্যান্ডের পৃথক পতাকার দাবি মানতে হবে। আরো বেশ কিছু সুযোগ সুবিধার দাবিও তারা করেছে। শুধু নাগাল্যান্ড নয়, মনিপুর, মিজোরাম, আসাম সহ একাধিক উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যেবিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আছে। এক সময় তারা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অশান্তি জারি ছিল উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু গত কয়েক দশকে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধানসূত্র বেরিয়েছিল। বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল। ফের তারা সহিংস রাস্তায় যেতে শুরু করেছে।
সীমান্ত নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই প্রভূত সমস্যায় রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। এক দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে লড়াই হয়েই চলেছে। অন্য দিকে লাদাখে ভারত-চীন সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। নেপালের মতো রাষ্ট্রও ভারতের সীমান্ত নিয়ে বিতর্কিত মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এই পরিস্থিতিতে চীন উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তেও অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দারা আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিল। বস্তুত, অরুণাচল সীমান্তে চীন সৈন্য বাড়িয়েছে বলেও সেনা সূত্র জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায় উদ্বেগ বেড়েছে সরকারের।
এসজি/জিএইচ (এনডিটিভি, পিটিআই)